নিজস্ব প্রতিবেদক
শিক্ষক লাঞ্ছনা ও হত্যা
দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ৬ মাসে ১০ হামলা
দেশে হঠাৎ করেই বেড়েছে শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা। সমাজে শিক্ষকদের সম্মান পুথিগত বিদ্যার মতোই মলাটবদ্ধ। বাস্তবের আলোর বাইরে। এতে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নৈতিক পতন হয়েছে। তা ছাড়া শিক্ষকদের ওপর বদলাচ্ছে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও। ফলে শিক্ষকদের প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে, লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে, জেল কাটতে হচ্ছে, স্থানীয় নেতাদের সামনে কান ধরে উঠবস করতে হচ্ছে। এভাবে ছয় মাসে অন্তত ১০টি ঘটনা ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত লাঞ্ছনা এসে ঠেকেছে হত্যাকাণ্ডে। ছাত্রীদের বখাটে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করলে সাভারে প্রভাষক উৎপল সরকারকে সবার সামনে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নড়াইলে মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে।
শিক্ষক নেতারা বলছেন, এসব ঘটনার বেশির ভাগেরই তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে শিক্ষক লাঞ্ছনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, শিক্ষকদের ওপর হামলাকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। সাভার ও নড়াইলে শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে কমিটি করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, এখন শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রদের সম্পর্ক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নৈতিক পতন হয়েছে। সংখ্যালঘু শিক্ষকদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে। কারণ, এই শিক্ষকদের দুর্বল ভাবা হচ্ছে। সাভারে সেই দুর্বলের ওপর আক্রমণ হয়েছে। ছাত্রটিও বুঝেছে, এই শিক্ষককে মারলে কোনো অসুবিধা হবে না।
গতকাল শুক্রবার ঢাকায় ‘আশির দশকের ছাত্র আন্দোলন, বিধান রায় ও আজকের প্রেক্ষিত’ শিরোনামের আলোচনা সভায় এ কথা বলেন তিনি।
স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলম সাজু বলেন, ‘আমাদের জন্য এটি একটি বেদনাদায়ক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতির জন্য এটি একটি কলঙ্ক। এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। একজন শিক্ষকের যদি জীবনের নিরাপত্তা না থাকে তাহলে দেশটা এগোবে কীভাবে।’
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে হবে। নইলে মেধাবীরা আর ই পেশায় আসতে চাইবে না।
শিক্ষা গবেষকরা বলছেন, শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনা পুরো সমাজের জন্য লজ্জাজনক। রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষকদের সম্মান বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে এ ধরনের ঘটনায় দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রোটোকলের জায়গায় তাদের যে অবস্থানটা ছিল সে জিনিসগুলো বিভিন্ন মেকানিজমের কারণে কমে গেছে। এই রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শিক্ষকদের অবস্থানটা নাজুক হয়ে পড়ছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, এটি নিরসন করতে হলে সবার সহযোগিতা দরকার। সেখানকার যে গণ্যমান্য ব্যক্তি আছেন, প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রশাসনের যারা আছেন সবার সহযোগিতাই পারে এই পরিবেশটা ভালো করতে।
এদিকে গতকাল বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদ আয়োজিত শিক্ষক প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা বলেন, বিভিন্ন জেলায় ঘটে যাওয়া শিক্ষক নির্যাতন পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, এসব ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বা সদস্যরা জড়িত।
প্রতিবাদ সমাবেশে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান বাবুল বলেন, ‘আজ শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে মারার সাহস পায় কীভাবে সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। শিক্ষার্থীর হাতে শিক্ষকের মৃত্যু এই প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম। শিক্ষক সমাজ আজ আতঙ্কিত, ভীত-সন্ত্রস্ত ও হতবাক।’
সংগঠনের সহসভাপতি মো. শফি উদ্দিন বলেন, শিক্ষক নির্যাতন থেকে শিক্ষা প্রশাসন বিদ্যমান আইন দ্বারা আমাদের সুরক্ষা দিতে পারছে না। আমরা শিক্ষক সমাজ শিক্ষকদের জন্য সুরক্ষা আইন চাই।’
প্রতিবাদ সমাবেশে সংগঠনের সভাপতি সেন্ড চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমাদের সবার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয়। আরো সহনশীল আচরণ করতে হবে। নড়াইলে যে ঘটনা ঘটেছে আমরা তার কী ব্যাখ্যা দেব। সেখানে কলেজ অধ্যক্ষের কী দোষ ছিল। বিনা অপরাধে বা অন্যের অপরাধের কারণে আবেগতাড়িত হয়ে কাউকে শাস্তি দিতে পারি না। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয়। সমাবেশ থেকে বক্তারা নড়াইলসহ সারা দেশে ধারাবাহিকভাবে যে শিক্ষক নির্যাতন তা বন্ধ করার জোর দাবি জানান।’
"