নিজস্ব প্রতিবেদক
নজর এখন নিরাপত্তায়
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে সফলভাবেই। এর স্থায়িত্ব ১২০ বছর হওয়ায় এখন সময় এসেছে দৃষ্টিনন্দন এ সেতুটির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের দিকে নজর দেওয়ার। এ বিষয়টি মাথায় রেখে এরই মধ্যে দেশের মেগা পরিবহন অবকাঠামো পদ্মা সেতু অক্ষত রাখার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে সেতু নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত স্বায়ত্তশাসিত সরকারি সংস্থা-বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু ব্যবহারকারীদের জন্য বিধিনিষেধ ও নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। দেশের এই মেগা পরিবহন অবকাঠামোর নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে গেল ২৩ জুন একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পদ্মা সেতুতে ৬০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চালানো যাবে না। এ ছাড়া সেতুর ওপর যেকোনো ধরনের যানবাহন দাঁড় করানো ও যানবাহন থেকে নেমে ছবি তোলা ও হাঁটা সম্পূর্ণ নিষেধ।
গাড়ির বডির চেয়ে বেশি চওড়া এবং ৫ দশমিক ৭ মিটারের চেয়ে বেশি উচ্চতার মালবাহী যানবাহন পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে পারাপার করা যাবে না বলেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশার মতো তিন চাকাবিশিষ্ট যানবাহন এবং হেঁটে ও সাইকেল বা নন-মোটরাইজড গাড়িতে করে পদ্মা সেতু পার হওয়া যাবে না বলে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্থাপনা হওয়ায় জনসাধারণকে পদ্মা সেতু পারাপারের সময় এসব নির্দেশনা মেনে চলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।
এদিকে, বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এখন বিদেশি উৎস থেকে তহবিল না পাওয়া গেলেও আমরা আমাদের নিজস্ব অর্থে, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম।’
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলামের মতে, ‘সেতুটি বাংলাদেশের প্রকৌশল খাতে কর্মরত সবার মনোবল বাড়িয়েছে। এটা সত্যিকার অর্থেই এক বড় অর্জন।’
পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ১৫০ দশমিক ১২ মিটার (৪৯২ দশমিক ৫ ফুট) দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার (৩ দশমিক ৮২ মাইল) দৈর্ঘ্য এবং ২২ দশমিক ৫ মিটার (৭৪ ফুট) প্রস্থের এ সেতুটিই এখন বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। স্প্যান এবং মোট দৈর্ঘ্য উভয় দিক বিবেচনায় এটিই দেশের সবচেয়ে বড় সেতু।
সিসি ক্যামেরা মনিটরিং : সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যান চলাচল মনিটরিং এবং ট্রাফিক নিয়ম লঙ্ঘন শনাক্ত করতে পদ্মা সেতুজুড়ে স্থাপন করা হবে হাই-ডেফিনিশন সিসি ক্যামেরা।
এ ক্যামেরায় সেতুতে ট্রাফিক নিয়ম বা শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী যানবাহন ধরা পড়বে এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পণ্যবাহী যানবাহনের অতিরিক্ত ওজনের বিষয়টিও সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান জানান, কোন গাড়ি কত দ্রুত যাচ্ছে, কোথাও দুর্ঘটনা ঘটছে কি না সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে এসব নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকেই দেখা যাবে।
পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় এর দুই পাড়ে চারতলা ভবনবিশিষ্ট দুটি নতুন থানা উদ্বোধনের পাশাপাশি সেখানে দুটি ফায়ার স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে বলেও জানান সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তারা জানান, পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে মাওয়া ও জাজিরায় দুটি টোল প্লাজায় ছয়টি করে বুথ বসানো হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে টোল আদায় হবে। বাকি পাঁচটিতে যানবাহন থামিয়ে নগদ লেনদেন হবে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ ফেরদৌস জানান, স্বয়ংক্রিয় টোল ব্যবস্থার সুবিধা নিতে যানবাহন মালিকদের প্রিপেইড কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। যানবাহনের সামনের দিকে একটি ট্যাগ থাকবে এবং এটি টোল প্লাজার কাছাকাছি এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টাকা কেটে নেওয়া হবে। এতে যানবাহন থামার প্রয়োজন হবে না। এ ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
এ ছাড়া চাহিদা অনুযায়ী টোল প্লাজায় বুথের সংখ্যা বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এটি জনগণ এবং ঠিকাদারের সমন্বয়ের ওপর নির্ভর করবে।’
পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনা চুক্তি : ৬৯৩ কোটি টাকায় পাঁচ বছরের জন্য পদ্মা সেতুর টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের চুক্তি হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন
(কেএসি) এবং চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির (এমবিইসি) সঙ্গে।
সেতু রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিষ্ঠান দুটিকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কেইসি সেতু চালুর পর থেকে পাঁচ বছরের জন্য সার্ভিস এরিয়া, অ্যাপ্রোচ রোড, টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ, ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম (আইটিএস) স্থাপন এবং ট্রাফিক নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পদ্মা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে দেশের যারা যুক্ত থাকবেন, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের কাজ শেখানো হবে। ফলে ভবিষ্যতে দেশের জনবল দিয়েই রক্ষণাবেক্ষণের কাজ অব্যাহত রাখা যাবে। পাশাপাশি সেতুর সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে নিয়মিত কাজ করে যাবে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।
আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্বের সেরা সব উপকরণ। কনসালটিং প্যানেলের অনুমোদন ছাড়া ঠিকাদারকে এ প্রকল্পে কোনো উপাদান ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। ফলে সেতুটি ১০০ থেকে ১২০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নির্দেশিকা জারি করার কথা উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে এই সেতুটির স্থায়িত্ব হবে ১০০ বছরেরও বেশি।
"