কাইয়ুম আহমেদ

  ২৬ জুন, ২০২২

স্বপ্ন হলো সত্যি

ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে সক্ষমতার পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে তিনি দেশের মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটালেন

বাতাসে উড়ল আবির, বর্ণিল উৎসবে খুলে গেল সম্ভাবনার অনন্ত দুয়ার; স্বপ্ন হলো সত্যি। মাওয়ায় পদ্মার তীরে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে সক্ষমতার পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শনিবার বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে তিনি ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটালেন। দুই দশক আগে তিনিই দক্ষিণ জনপদের ২১ জেলার মানুষের স্বপ্নের এ সেতুর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। শুধু উদ্বোধন নয়, সেতুতে টোল দিয়ে তিনিই এ সেতুর প্রথম যাত্রী হলেন।

১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুনেছিলেন এই স্বপ্নের বীজ। তবে শুরুতে এই যাত্রা ছিল বন্ধুর। বিশ্বব্যাংক ২০১২ সালের ৩০ জুন সেতুর ১২০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তার চুক্তি বাতিল করে। তাদের দেখাদেখি নিজেদের সরিয়ে নেয় জাইকা, এডিবি ও আইডিবি। ঋণদাতাদের চাপ, দেশে-বিদেশে নানা সমালোচনার মুখে সরিয়ে দেওয়া হয় ওই সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের দিকেও অভিযোগের আঙুল ওঠে। প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামের নাম কাটা পড়ে। ওই সময়ের সেতুু সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব কাজী মোহাম্মদ ফেরদৌসকে যেতে হয় কারাগারে। মাঠে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরাও আসেন তদন্তে। এরপর ২০১২ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করবে বাংলাদেশ। বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করে পারবে তো বাংলাদেশ। হ্যাঁ, পেরেছে বাংলাদেশ। বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া প্রথমবারের মতো একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ নিয়ে তা করে দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রমত্ত পদ্মার বুকে কারিগরি নানা জটিলতা কাটিয়ে নির্মাণ করেছেন সেতু। এর আগে ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তর-পশ্চিম এবং অন্য অঞ্চলের সংযোগকারী যমুনা নদীর ওপর ১৯৯৮ সালে দীর্ঘতম বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু চালু করেছিলেন তিনি। এর ঠিক ২৫ বছর পর তিনি পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলেন।

এই সেতুর উদ্বোধন ঘিরে মাওয়া এবং অন্য পাড়ে শিবচর ও জাজিরায় চলে আনন্দ উৎসব। দুই পাড়েই দুটি সুধী সমাবেশ ও জনসভার আয়োজন করা হয়। মাওয়া প্রান্তের সুধী সমাবেশ দিয়ে শুরু, মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা এবং শিবচরের কাঁঠালবাড়ীতে জনসমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয় উদ্বোধনী পর্ব। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কর্মকর্তা, বিদেশি রাষ্ট্রদূত, রাজনৈতিক নেতা, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ নানা উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ছিলেন সেতুর কাজে যুক্ত থাকা বিদেশি এবং দেশের প্রকৌশলীরা।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকী ছাড়াও ২০১২ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ ওঠায় (যদিও অভিযোগের কোনো প্রমাণ মেলেনি) পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং তখনকার যোগাযোগ সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াও উপস্থিত অনুষ্ঠানে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে থিম সং বাজানো হয় এবং পদ্মা বহুমুখী সেতুর ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী সেতু উদ্বোধন মঞ্চে উঠেন। সেখানে দেশজাতির মঙ্গল কামনা করে মোনাজাতে শরিক হন। তারপর মঞ্চের পাশে গিয়ে বোতাম চেপে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন। বোতাম চাপার মধ্য দিয়ে সেতু উদ্বোধনের ম্যুরালের সামনে থেকে পর্দা সরে যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার মেয়ে প্রধানমন্ত্রীর ছবি এই ম্যুরালে স্থান পেয়েছে। এ সময় তিনি মোবাইল ফোনে ভিডিও কলে স্বজনের সঙ্গে কথা বলেন এবং কিছু সময় লাইভে থাকেন।

জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে জাজিরা প্রান্তে হয় জনসভা। এই প্রান্তে লাখো মানুষের সমাবেশে শিবচর থেকে এসেছিল তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুল নাঈম পিয়া। তার ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একনজর দেখা। কেমন লাগছে জানতে চাইলে পিয়া বলে, খুবই ভালো লাগছে। এত মানুষ এখানে। ঈদের মতো খুশি লাগছে আমার।

সঙ্গে থাকা পিয়ার বাবা ফজলু কবীর বলেন, আমাদের মাদারীপুরের বাসিন্দাদের জন্য আজকে সত্যিই ঈদ। এই সেতু আমাদের জন্য স্বপ্ন ছিল। আজকে সেটা বাস্তব। মেয়েকে এই ইতিহাসের সাক্ষী করার জন্যই এত ভিড় ঠেলে আজকে এখানে এসেছি।

বহু প্রতীক্ষিত এই সেতু উদ্বোধনের দিন শরীয়তপুরে জাজিরা প্রান্তে জনসভার আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। মাওয়া প্রান্তে বর্ণিল আয়োজনে উদ্বোধনের পর গাড়িতে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে জাজিরা প্রান্তে এসে জনসভায় যোগ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। দুপুরের এই জনসভায় যোগ দিতে দক্ষিণাঞ্চলের নানা প্রান্ত থেকে সকাল থেকেই মানুষ জড়ো হতে থাকে জাজিরায়।

এমনই একজন গোবিন্দ চন্দ্র ঘোষ, লঞ্চে ৩ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঘড়িসার থেকে এসেছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় এই নেতা।

উচ্ছ্বসিত গোবিন্দ বলেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হলো এর চেয়ে খুশির দিন আমাদের কাছে আর হতে পারে না।

এর আগে সকালে ঢাকার তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারে করে মাওয়ায় পদ্মা সেতু সার্ভিস এরিয়ায় এসে নামেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে সুধী সমাবেশে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। সমাবেশে বক্তব্য শেষে স্মারক ডাক টিকিট, স্মারক নোট, স্যুভেনির শিট, সিলমোহর ও উদ্বোধন খামের মোড়ক উন্মোচন করেন। সেতু নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত প্রকৌশলীদের সঙ্গে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গ্রুপ ছবি তুলতে দাঁড়ান ক্যামেরার সামনে।

সুধী সমাবেশ শেষ করে বেলা ১১টা ৪৯ মিনিটে ৭৫০ টাকা টোল দিয়ে প্রথম যাত্রী হিসেবে পদ্মা সেতু এলাকায় প্রবেশ করেন সরকারপ্রধান। শুধু নিজের গাড়ির নয়, বহরে থাকা সব গাড়ির মোট ১৬ হাজার ৪০০ টাকা টোল মিটিয়ে বেলা ১১টা ৪৯ মিনিটে পদ্মা সেতুর দিকে এগিয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর। গাড়িবহর মূল সেতুতে ওঠে বেলা ১২টা ৭ মিনিট। মাঝখানে এসে বহরের সবাইকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে সেতুতে দাঁড়ান শেখ হাসিনা। সেখানে প্রায় ১৫ মিনিট সময় কাটান তিনি; উপভোগ করেন বিমান ও হেলিকপ্টারের ফ্লাইং ডিসপ্লে। কয়েকটি হেলিকপ্টার পতাকা উড়িয়ে প্রদর্শনীতে অংশ নেয়। বিমান থেকে ছড়ানো লাল, সবুজ, নীলসহ নানা রঙের ধোঁয়া। উৎসবের এ মুহূর্তগুলো ক্যামেরায় ধারণ করতে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও সেতুর ওপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close