মো. মনির হোসেন, বেনাপোল (যশোর) থেকে

  ২২ জুন, ২০২২

পদ্মা সেতু : বেনাপোলে সম্ভাবনার হাতছানি

পদ্মা সেতু সৌভাগ্যের ডালি সাজিয়ে হাজির হচ্ছে বেনাপোল স্থলবন্দরবাসীর জন্য। এই সেতুকে কেন্দ্র করে বেনাপোলে রয়েছে উন্নয়নের উদ্যোগ। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে পরিকল্পিতভাবে এসব উন্নয়ন প্রকল্প শুরু করা হবে বলে জানাল স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।

বন্দর ব্যবহারকারীদের দাবি, পদ্মা সেতু চালুর সঙ্গে সঙ্গে চাপ বাড়বে বেনাপোল বন্দরে। কিন্তু, সেই চাপকে সামাল দিতে না পারলে ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। সে কারণে অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ নানা সুপারিশ করেছেন তারা। তবে, বসে নেই স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষও। সব সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে বেনাপোলকে সত্যিকার অর্থেই একটি আন্তর্জাতিক মানের স্থলবন্দর তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫৬ কোটি টাকার তিনটি প্রকল্পও পরিচালনা করা হচ্ছে, যা সম্পন্ন হতে সময় লাগবে আরো দুই বছর। তখন পাল্টে যাবে বেনাপোল বন্দরের দৃশ্যপট। অবসান হবে সব সমস্যার। যার সুফল ভোগ করবেন আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সথেঙ্গ যুক্ত বন্দর ব্যবহারকারী পাসপোর্ট যাত্রীরা।

পদ্মা সেতু চালুর পর আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ও পাসপোর্ট যাত্রীদের যে বাড়তি চাপ তৈরি হবে তা সামাল দেওয়ার সক্ষমতা বেনাপোল স্থলবন্দরে আছে কি না- সে বিষয়ে এসব কথা উঠে আসে। এ সময় কথা হয় কাস্টমস, স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় আমদানি-রপ্তানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতা ও অন্যদের সঙ্গে।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি খায়রুজ্জামান মধু পদ্মা সেতুকে তাদের জন্য সৌভাগ্য হিসেবে দাবি করলেও অভিযোগ করেছেন, বেনাপোল বন্দরে পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে হয়তো আমাদের সামনে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। তিনি বলেন, জায়গা সংকটের কারণে আমদানি করা মাল লোড-আনলোড করতে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। রয়েছে উপকরণেরও অভাব। বিশেষ করে ফর্কলিফটের যথেষ্ট অভাব আছে।

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কপোতাক্ষ এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মশিয়ার রহমানের অভিযোগ গুরুতর। তার দাবি, যারা এই পোর্ট দিয়ে দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসা করছে তারা বর্তমানে খুবই নির্যাতিত, অবহেলিত। বর্তমানে ভারত থেকে এক গাড়ি পণ্য বেনাপোল বন্দরে আসতে এক মাসেরও অধিক সময় লাগছে। এক কনসাইনমেন্ট পণ্য ভারত থেকে বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমদানি করায় ওপারে আমদানিকারকদের এক মাসে অতিরিক্ত গুনতে হয় ৬৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার রুপি। বাড়তি এই খরচ পরে পণ্যের ওপর পড়ে ভোক্তার কাঁধে চাপে।

তিনি আরো বলেন, বন্দরে জায়গা সংকটের কারণে এক গাড়ি পণ্য আনলোড হতে সময় লাগে সাত থেকে দশদিন। ট্রাকগুলো এক শেড থেকে আর এক শেডে ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় যেনো এগুলো বেওয়ারিশ। এ শেড ইনচার্জ বলে জায়গা নেই, ওই শেড ইনচার্জ বলে জায়গা নেই। এতে দীর্ঘদিন ট্রাকে পণ্য থাকার কারণে মালের গুণগত মানও নষ্ট হচ্ছে। তিনি মনে করেন, দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান করতে না পারলে পদ্মা সেতুর প্রভাবে যে চাপ বেনাপোল বন্দরে তৈরি হবে তা মিটিয়ে পরিপূর্ণ সুফল ঘরে তোলা দুরূহ হয়ে উঠবে।

যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, সোনামসজিদ বা বাংলাবন্ধে যেসব পণ্য চালান আসে সেগুলোকে অনেক ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। অন্যদিকে, বেনাপোল হলো ভারতের কলকাতায় প্রবেশদ্বার এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। সে কারণে ব্যবসায়ীরা চাইবেন বেনাপোল দিয়ে অধিক পণ্য পাঠাতে। কিন্তু, বেনাপোলে তো অবকাঠামো বলতে কিছু নেই। এর আমূল উন্নতি ছাড়া পদ্মা সেতুর সুফল পাওয়া যাবে না বলে মনে করেন এ ব্যবসায়ী নেতা।

বেনাপোল আমদানি ও রপ্তানিকারক সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক আনু বলেন, পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত উন্নয়ন বেনাপোল বন্দরে ঘটেনি। প্রতিদিন এক হাজার ট্রাক পণ্য ভারত থেকে আমদানি করার সুযোগ থাকলেও স্থান সংকটের কারণে মাত্র দুই থেকে তিন শ ট্রাক পণ্য আসে বন্দরে। পদ্মা সেতুর সুফল যদি আনতে হয় বন্দরের সক্ষমতা দ্বিগুণ করতে হবে, সিসিটিভি ক্যামেরা কার্যকর করতে হবে, যানজট দূর করতে হবে এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বন্দরের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বন্দরে ক্রেন, ফর্কলিফট বাড়াতে হবে। জনবল দ্বিগুণ করতে হবে।

বন্দর ব্যবহারকারীদের অভিযোগ কিছুটা সঠিক বলে মনে করেন বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার আজিজুর রহমানও। তিনি বলেন, বন্দরের কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। বন্দরে এখন সক্ষমতা আছে বছরে ৪৫ হাজার টন ধারণ করার। কিন্তু বছরে এক লাখ টনেরও বেশি পণ্য লোড-আনলোড হচ্ছে। এখানে নতুন নতুন কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন হলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ দু-তিনটা প্রকল্প দিয়ে সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্যই শেড বাড়াতে হবে, এটার বিকল্প নেই। আমদানিকারক-রপ্তানিকারকদের দাবিকে মাথায় রেখে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এটাকে সম্প্রসারিত করবে বলে আমার বিশ্বাস।

বন্দরের সমস্যার পাশাপাশি কাস্টমসেরও কিছু প্রস্তুতির কথা জানান কাস্টমস কমিশনার। তিনি বলেন, চাহিদা তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। সেই চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। কাস্টম হাউস এখন যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে যদি আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি পায় তাহলে সেইভাবে আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী আরো বেশিসংখ্যক নিয়োগ দিতে হবে। সেটা পূরণ করা সম্ভব। সেভাবেই আমরা কার্যক্রম সম্পন্ন করব।

এদিকে, পদ্মা সেতু চালুর সঙ্গে সঙ্গে বেনাপোল বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজও এগিয়ে চলেছে বলে দাবি করেছেন বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার। বন্দরে ৩৫৬ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। এ প্রকল্প শেষ হলেই বন্দরের স্থান সংকট দূর হওয়ার পাশাপাশি পণ্যের নিরাপত্তা বাড়বে এবং পণ্যের গুণগত মানও অক্ষুণœ থাকবে।

তিনি বলেন, ভারত-বাংলাদেশ ব্যবসা বৃদ্ধির কারণে পরিবহনের চাহিদাও বাড়বে। এটি মাথায় রেখে আমরা ২৫ একর জায়গা অধিগ্রহণ করেছি। পরে আরো সাড়ে ১৬ একর জায়গা অধিগ্রহণ হয়েছে। আরো এক শ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে।

মামুন কবীর তরফদার বলেন, ২৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে জিরো পয়েন্টের পাশে ২৫ একর জমিতে নির্মাণ হচ্ছে কার্গো ভেহিকেল টার্মিনাল। এ কাজ শেষ হবে আগামী বছরের মধ্যে। এই টার্মিনালে একসঙ্গে তিন শ পণ্যবাহী ট্রাক অবস্থান নিতে পারবে। ভারত থেকে পণ্য নিয়ে আসা ট্রাকগুলোই এই টার্মিনালে অবস্থান করবে, তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে না। এতে একদিকে যেমন দ্রুততম সময়ের মধ্যে পণ্য আনলোড করা যাবে, তেমনি বাংলাদেশ অংশে যানজট দূর হবে।

এর পাশাপাশি ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে ১৫ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন বাউন্ডারি ওয়াল। এই ওয়ালের ভেতরে যে কেউ ইচ্ছা করলে প্রবেশ করতে পারবে না। কারণ, অটোমেশন সিস্টেমের আওতায় এর নিয়ন্ত্রণ থাকবে কর্তৃপক্ষের হাতে। এই ওয়ালের দৈর্ঘ্য সাড়ে পাঁচ হাজার মিটার। বন্দরের ভেতরে অনধিকার প্রবেশ ও চুরি রোধসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। আগামী দুই বছরের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্প শেষ হলেই পাল্টে যাবে বন্দরের সার্বিক চিত্র। এ ছাড়া, সার্বিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পুরো বন্দরকে সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসার প্রকল্পও প্রায় সমাপ্তির পথে বলে জানান মামুন কবীর তরফদার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close