সিলেট ব্যুরো

  ২২ জুন, ২০২২

সিলেট অঞ্চলে বন্যার আরো অবনতি

সিলেট নগর থেকে পানি নামলেও বিস্তীর্ণ এলাকা এখনো পানিতে নিমজ্জিত। জেলার জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জ, বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর তীর উপচে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। বন্যার বিস্তৃতি ঘটছে। পানিবন্দি রয়েছেন অর্ধকোটি মানুষ। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত জনজীবন। আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যার্তরা পাচ্ছেন অপ্রতুল ত্রাণ। সেখানে রয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট। নগরে পচা পানির দুর্গন্ধ আর বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে, সিলেটে সুরমা নদীর পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলেও বাড়ছে কুশিয়ারা নদীর পানি। এখনো নগরীর নিম্নাঞ্চলের বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাট নিমজ্জিত রয়েছে। নগরীর উপশহরের প্রধান সড়কে এখনো কোথাও হাঁটু সমান পানি রয়েছে। দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান বলেন, সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। দুর্গত এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা সমন্বিতভাবে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।

এদিকে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে পানি সরলেও দিকনির্দেশনামূলক অ্যাপ্রোচ লাইট তলিয়ে থাকায় বিমান চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। রানওয়েতে পানি ওঠায় গত শুক্রবার ওসমানী বিমানবন্দর তিন দিনের জন্য বন্ধ করা হয়। পানি নামলেই ফ্লাইট চালুর শুরু হবে বলে জানিয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। এর আগে বিমানবন্দর পরিদর্শন করেছেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী।

এদিকে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) এবং সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) ক্যাম্পাস থেকে পানি নেমে গেছে। তবে এখনো ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।

স্ত্রী-সন্তান ও মাকে নিয়ে ট্রাকেই বসবাস : ১২ বছর ধরে ট্রাক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন শাহজাহান। চালকের আসনের বসে সারা দিন গাড়ি চালিয়ে এলেও রাতে ঠিকই ঘুমাতেন বাড়িতে গিয়ে। কিন্তু গত ৬ দিন ধরে পরিবার-পরিজন নিয়ে শাহজাহানের দিনরাত কাটছে তার সেই ট্রাকে। ভয়াবহ বন্যায় ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় অসহায় হয়ে অবশেষে ট্রাকেই আশ্রয় নিতে হয়েছে শাহজাহানকে। বাড়ির সামনে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়কের পাশে ট্রাকের মধ্যেই হাস-মুরগিসহ বসবাস করছেন তারা।

শাহজাহান কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ রণিখাই ইউনিয়নের গৌরীনগর গ্রামের মৃত বশির মিয়ার ছেলে। তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও মা রয়েছেন। সোমবার দুপুরে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়কের গৌরীনগর এলাকায় কথা হয় শাহজাহানের সঙ্গে।

শাহজাহান বলেন, পাহাড়ি ঢলের প্রবল স্রোতে ৬ দিন আগেই ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। কোথাও জায়গা না পেয়ে মালিকের অনুমতি নিয়ে ট্রাকের মধ্যেই জায়গা করে নিয়েছি। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ট্রাকের ওপরে পলিথিন দিয়ে চাল তৈরি করেছি। কোনো মতে স্ত্রী, দুই সন্তান ও মাকে নিয়ে বেঁচে আছি। অনুমতি দেওয়ায় হাস-মুরগিসহ সবাইকে নিয়ে ট্রাকে আশ্রয় নিয়েছি। ট্রাকে রান্না করার জন্য একটি চুলা ও গ্যাসের সিলিন্ডার পাঠিয়েছেন মালিক। এখন যা ত্রাণ পাচ্ছি তা দিয়ে কোনো মতে চলছে।

মা-ছেলের মরদেহ উদ্ধার : সিলেটের জৈন্তাপুরে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া মা-ছেলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। গত সোমবার সকালে উপজেলার দরবস্ত এলাকায় তাদের মরদেহ ভেসে উঠে। নিহতরা হলেন দরবস্ত ইউনিয়নের কলাগ্রামের বাসিন্দা নাজমুন্নেসা ও তার ছেলে আবদুর রহমান।

জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল বশিরুল ইসলাম বলেন, গত শুক্রবারে নাজমুন্নেছা তার ছেলেকে নিয়ে পাশের গ্রামে মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন। মেয়ের বাড়িতে পানি উঠে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে মা-ছেলে সড়কের পাশে পানিতে তলিয়ে যান। আজকে তাদের মরদেহ ভেসে উঠেছে।

আশ্রয়কেন্দ্রের পর মাথা গোজার ঠাঁই নিয়ে শঙ্কিত বন্যার্তরা

স্যার আমার নামটা লেখউক্কা (লেখেন)। আমার কিচ্ছু রইছে না। সবতা ভাসাইয়া নিছে গিয়া। ঘরের টিন থাকি শুরু করি হকলতা ভাসিয়া গেছে গিয়া। আমি এখন গিয়া কার দুয়ারে উঠমু। আমারে আপনারা দয়া না করলে আমি মশকিল (মুশকিল)। এ প্রতিবেদককে দেখে এভাবেই নিজের অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নাজমা বেগম। ভয়াবহ বন্যায় ঘরবাড়ি হারিয়ে এখন নিঃস্ব তিনি। সব হারিয়ে জায়গা পেয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। 

নাজমা মিত্রিমহল উত্তরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। আশ্রয়কেন্দ্রে মাথা গোজার ঠাঁই মিললেও শঙ্কা কাটছে না তার। পানি কমলে কোথায় গিয়ে ওঠবেন সে চিন্তায় এখনই ভর করেছে তাকে। শুধু প্রতিবন্ধী রহিমা বিবি নয়। ঘর দুয়ার হারিয়ে অসংখ্য রহিমাদের চিন্তা এখন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ঘরবাড়ি নিয়ে। আশ্রয়কেন্দ্রে বেঁচে থাকার মতো সুবিধা পেলেও ঘরে ফেরা নিয়ে শঙ্কা তাদের। আর এজন্যই আশ্রয়কেন্দ্রে বাহিরের (বন্যার্ত ছাড়া) কাউকে দেখলেই সরকারি কর্মকর্তা ভেবে ছুটে আসেন সবাই। সরকার থেকে সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে ভেবে তাদের নাম তালিকাভুক্ত করতে হুলস্থুল শুরু করেন তারা। 

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার মিত্রিমহল এলাকার বশির কমিউনিটি সেন্টার দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে আশ্রয় নেওয়া কমলা বেগম বলেন, স্বামীহারা সংসারে ছোট ছোট পাঁচজন সন্তান নিয়ে কোনো মতে জীবনযাপন করতাম। গত মাসে প্রথম দফা বন্যায় ঘর ডুবে যায়। বিভিন্নজনের কাছে থেকে সহযোগিতা নিয়ে ঘর ঠিক করেছি। কিন্তু এখন বন্যায় ঘরের চাল থেকে শুরু করে সব নিয়ে গেছে। মাথা গোজার আর জায়গা নেই। এলাকার সবাই আমার মতো ক্ষতিগ্রস্ত। ওই আশ্রয়কেন্দ্রের আরেক বৃদ্ধা সাহিদা বেগম বলেন, আমি ভিক্ষা করে খাই। ভিটে বলতে যেটা ছিল সেটাও পানিতে গলে গেছে। আর কিছু বাকি নাই। পানি কমলে তো বাড়িতে যেতে হবে। কিন্তু ঘরবাড়ি সব বানের পানিতে।

মিত্রিমহল থেকে আরো ৪/৫ কিলোমিটার সামনে গেলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার গৌরীনগর গ্রাম। এই এলাকার চিত্র পুরো ভিন্ন। পানির নিচে বিস্তীর্ণ এলাকা। কেবল ভেসে আছে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়ক। সেই সড়কেই অবস্থান করেছেন শত শত মানুষ। সড়কের পাশেই কেউ করে নিয়েছেন থাকার জায়গা। আবার কেউ সড়কে ট্রাকের মধ্যে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। তবে বেশির ভাগ মানুষ ত্রাণের জন্য রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ আবার নীরবে খুঁজছেন সরকারি কর্মকর্তাদের। বন্যা-পরবর্তী সরকারি তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য।

গৌরী নগর গ্রামের জিয়া উদ্দিন বলেন, সকাল থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। শুনেছি যারা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন তাদের সরকার ঘরবাড়ি বানিয়ে দেবে। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে খুঁজছি কোনো সরকারি কর্মকর্তার দেখা মিলে কি না।

জিয়া উদ্দিন বলেন, ৬ দিন ধরে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছি। বাড়ি থেকে পানি নামতে আরো দু-তিন দিন লাগতে পারে। কিন্তু ঘরবাড়ি একেবারে শেষ। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে কোথায় ওঠব তা জানি না। সরকারি সহযোগিতা না পেলে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে আরো কারো বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে। একই অবস্থা সিলেটের জকিগঞ্জ, কানাইঘাট ও সদর উপজেলার হাজার পরিবারের মধ্যে। এ বিষয়ে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আনোয়ার সাদাত বলেন, বন্যার্তদের পুনর্বাসন নিয়ে এখনো কোনো কাজ করা হচ্ছে না। বন্যার পানি নামার পর ২১ দিনের মধ্যে একটি তালিকা প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হবে। আগে মানুষ বাঁচুক। তারপর ঘরবাড়ির বিষয়টি দেখা যাবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close