সিলেট প্রতিনিধি

  ২০ জুন, ২০২২

ভাঙন-দুর্ভোগ-বিপর্যয়ে দিশাহারা বন্যার্ত

* আশ্রয়শিবিরে খাদ্য ও পানি সরবরাহ * চিকিৎসাসেবায় ১৪০ মেডিকেল টিম

বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট রেলস্টেশন থেকে গত শনিবার থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে গতকাল পানি নেমে যাওয়ায় ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। দুপুরে সিলেটের স্টেশন ম্যানেজার নুরুল ইসলাম রেল যোগাযোগ স্বাভাবিকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এদিকে, যমুনার পানি বেড়ে সিরাজগঞ্জে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে, তিস্তা, ধরলা, রত্নাই, সানিয়াজান ও স্বর্ণামতি নদীর পানি বেড়ে লালমনিরহাটের প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে যমুনার ভয়াবহ ভাঙনে তিনটি স্কুলসহ এক হাজার বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। জামালপুরের বকশীগঞ্জে এক কিলোমিটারজুড়ে শুরু হয়েছে ভাঙন, নেত্রকোনার দুর্গাপুরে পানি কমলেও দুর্ভোগ বেড়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট-

সিলেট : সিলেটের স্টেশন ম্যানেজার নুরুল ইসলাম জানান, বন্যার পানি কিছুটা কমায় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন সিলেট রেলস্টেশন পর্যন্ত যেতে পারছে। এদিকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড ও বিমানবন্দরসহ নগরের বেশির ভাগ এলাকায় পানি ওঠে। এতে স্বাভাবিক যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

অন্য দিকে প্লাবিত হয়েছে সিলেট নগরীসহ ১৩টি উপজেলা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। বন্যার্তদের মধ্যে কিছু মানুষ জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে খোলা ৩৫৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা পেয়েছেন। জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রগুলোতে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ২১ হাজার ৫২২ জন আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া এসব আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পৃথক ব্যবস্থায় ২১ হাজার ১০২টি গবাদিপশুও রাখা হয়েছে।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বন্যার শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত সিলেটের ১৩ উপজেলায় উদ্ধার, ত্রাণ কার্যক্রমে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি সেনা ও নৌবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সিসিকসহ বিভিন্ন দপ্তর কাজ করে। এ ছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় ১৪০টি মেডিকেল টিমও কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চারটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বসিয়ে বন্যার্তদের মধ্যে সুপেয় পানি সরবরাহের কাজ চলছে।

সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর পানি আরো বাড়ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ নদণ্ডনদীর পানিও। এতে সিরাজগঞ্জে ঘটছে বন্যার বিস্তার। সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার পুঠিয়াবাড়ী, চরমালশাপাড়াসহ বাঁধ অভ্যন্তরে বাড়িঘর একং নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের ফসল ডুবে গেছে। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি ২১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। এ ছাড়া জেলার অভ্যন্তরীণ করতোয়া, ফুলঝোর, ইছামতি, বড়ালসহ বিভিন্ন নদণ্ডনদী ও খাল বিলের পানি বাড়ছে। জেলার কাজিপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, চৌহালী ও সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। এতে তিল, কাউন, বাদাম, পাট ও সবজিসহ বিভিন্ন ফসল ডুবে গেছে।

অন্য দিকে গত শনিবার এনায়েতপুর থানার খুকনি ইউনিয়নে যমুনার ভাঙনকবলিত ব্রাহ্মণগ্রামসহ ডানতীরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন পানিসম্পদ সচিব কবীর বিন আনোয়ার। জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান জানান, বন্যাদুর্গত বানভাসি মানুষের মাঝে বিতরণের জন্য এরই মধ্যে ৯১১ টন চাল, নগদ ২০ লাখ টাকা এবং ৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ পাওয়া গেছে।

লালমনিরহাট : তিস্তা, ধরলা, রত্নাই, সানিয়াজান ও স্বর্ণামতি নদীর পানি বেড়ে লালমনিরহাটের প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গতকাল দুপুর ১২টায় ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার মাত্র ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছিল। এর আগে শনিবার রাতে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটারের উপর দিয়ে বইছিল। আর পানি কমলেও বন্যার বিস্তার থেমে নেই। ফলে নদী তীরবর্তী জেলার পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারী ও সদরের ১০ হাজারেরও বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট ডুবে গেছে, মানুষ ও যানচলাচল ব্যাহত হচ্ছে। স্কুল-কলেজ চত্বরে পানি উঠেছে, শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়েছে। শুকনো খাবার ও নিরাপদ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়াও গৃহপালিত গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়েও বিপাকে পড়েছেন তিস্তা পারের মানুষ।

দৌলতপুর (মানিকগঞ্জ) : মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার বাঘুটিয়া, বাচামারা, চরকাটারী এই তিন ইউনিয়নে যমুনা নদীর ভয়াবহ ভাঙনে তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রায় এক হাজার পরিবারের বসতভিটাসহ ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। জায়গা জমি সহায়-সম্বল হারিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত পরিবারের লোকজন। চরম অনিশ্চয়তায় খোলা আকাশের নিচে দিন কাটছে তাদের। নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আকস্মিক ভাঙন দেখা দেয়। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে এভাবেই যমুনার ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে অসংখ্য পরিবার। ভাঙনে দিশাহারা দৌলতপুর উপজেলার যমুনা তীরবর্তী মানুষ।

এরই মধ্যে দৌলতপুর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের মুন্সিকান্দি, পাচুরিয়া, ইসলামপুর, বাসাইল, জোতকাশি, রাহাতপুর; বাচামারা ইউনিয়নের বাগসাইট্টা, সুবুদ্দিয়া, নিজ ভারাঙ্গ উত্তর খন্ড, চরভারাঙ্গা দক্ষিন খন্ড; চরকাটারী ইউনিয়নের চরকাটারী মন্ডলপাড়া, সেক পাড়া, চরগোবিন্দপুর মন্ডলপাড়া, সধিরেরপাড়া, ৩৩নং চরকাটারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩১নং যমুনা চরকাটারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরকাটারী সবুজ সেনা উচ্চবিদ্যালয়সহ এই তিনটি ইউনিয়নের ১৬টি গ্রামের প্রায় এক হাজার পরিবারের বসতভিটা ও ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনঝুঁকিতে রয়েছে আরো অসংখ্য ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি।

কুড়িগ্রাম : পানিবন্দি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদ বেষ্টিত দুর্গম পোড়ার চর গ্রামে গতকাল ত্রাণ বিতরণ করে প্রশাসনের লোকজন। এ সময় দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলেন কর্মকর্তারা। গত এক সপ্তাহ ধরে এই চরের মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে নৌকার মধ্যে অবস্থান নিয়েছিল। দেড় শতাধিক পরিবার অধ্যুসিত এই চরের বাড়িঘরে দরজা-জানালা পর্যন্ত পানি ওঠে গেছে। অনেক বাড়িতে ঢোকার মতো অবস্থা ছিল না। বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর ওঠে আসায় প্রশাসনের লোকজন পোড়ারচরসহ পার্শ্ববর্তী চর ভগবতিপুর ও চর যাত্রাপুরে ৩ শতাধিক বানভাসিদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করে। পানিবন্দি এসব পরিবার ত্রাণ পেয়ে খুশি।

বকশীগঞ্জ (জামালপুর) : জামালপুরের বকশীগঞ্জে বন্যার পানির তীব্র স্রোতে এক কিলোমিটারজুড়ে তীব্র নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। চোখের সামনেই বিলীন হচ্ছে ফসলি জমিসহ বসতভিটা। নদীর তীব্র ভাঙনের এখেলায় জমির মালিকরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। ব্রহ্মপুত্র নদ, দশানী নদী ও জিঞ্জিরাম নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধুরপাড়া ইউনিয়নের চর আইরমারী গ্রামে দশানীতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়ে এই গ্রামের ফসলি জমি নদীতে বিলীন হচ্ছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন নদীভাঙনের কারণে ১০০ বিঘা ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে।

দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) : বন্যা পরবর্তী দুর্ভোগ নিয়ে শনিবার ও রবিবার উপজেলা বিভিন্ন ইউনিয়নে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বন্যার পানি কমলেও বন্যার্তদের দুর্গতি বেড়েছে। দুর্গাপুর উপজেলার পৌরসভাসহ ৭টি ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। উপজেলাবাসীদের আউশ ফসলের বীজতলা, পুকুরের মাছ, মুরগির খামার, গবাদি পশু ও শাক-সবজি, রাস্তাঘাট, বাড়িঘরসহ সবকিছু বিনষ্ট করে দিয়ে গেছে। কৃষি শ্রমিক মনসুর আলী বলেন, কাজ কাম নেই কিন্তু পেট তো রোগ-বালাই চিনে না, তাকে সময়মতো কিছু দিতে হবে। কোথায় পাব? তাই বাধ্য হয়ে, প্রতিবেশীর কাছ থেকে কিছু টাকা সুদে নিয়েছিলাম। এখন টাকা দেব কীভাবে? লাভ না দিলে কেউ টাকা দেয় না। এলাকার খোদেজা, মাকসুদাসহ অনেকেই একই ধরনের কথা বলে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close