প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১৯ জুন, ২০২২

অতিবৃষ্টি ছাড়াও হঠাৎ বন্যার আরো কারণ

সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোয় হঠাৎ শুরু হওয়া বন্যার পেছনে অতিবৃষ্টির বাইরে আরো কয়েকটি কারণ দেখছেন গবেষকরা। এই বছর এ নিয়ে তৃতীয় দফার বন্যার কবলে পড়েছে এসব জেলা। সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা বলছেন, বহু বছরের মধ্যে তারা এত মারাত্মক বন্যার মুখোমুখি হননি। পাশাপাশি রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারীসহ দেশের আরো অন্তত ১৭টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলছেন, গত তিন দিন চেরাপুঞ্জিতে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৪৮৭ মিলিমিটার এবং এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। এ রকম ধারাবাহিক বৃষ্টি হয়েছে ১৯৯৫ সালে একবার, তিন দিনে ২৭৯৮ মিলিমিটার আর ১৯৭৪ সালে ২৭৬০ মিলিমিটার। এ রকম খুব কম দেখা গেছে। সেখানকার পানি সরাসরি বাংলাদেশের হাওরে এসে মেশে। ভৈরব, মেঘনা বা যমুনা নদী হয়ে সাগরে চলে যায়।

অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে এখন বৃষ্টি হলে অনেক বেশি গভীর বৃষ্টি হয়। প্যাসিফিকেও একটা লা নিনো আছে। সেটাও অতিবৃষ্টির পেছনে ভূমিকা রেখেছে।’

চেরাপুঞ্জিতে যখন বৃষ্টি হয়, সেটা ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতরে তাহিরপুরে চলে আসে। কিন্তু সেখানে এসে পানি তো আর দ্রুত নামতে পারছে না। ফলে তখন সেটা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে বন্যার তৈরি করছে। অতিরিক্ত পানি বের হতে না হওয়ার জন্য তারা নদীর নাব্য কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন।

নদী গবেষক মুমিনুল হক সরকার বলছেন, প্রতি বছর উজান থেকে পানির সঙ্গে পলি আর পাথর নেমে আসে। সেটা এসে বাংলাদেশের অংশে নদীর তলদেশ ভরে ফেলে। নদীর পানি বহনের ক্ষমতা কমে যায়। তখন এই নদীতে বেশি পানি আসলে সেটা উপচে আশপাশের এলাকা ভাসিয়ে ফেলে। নদীর নাব্য নষ্টের জন্য ভারত অংশে অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলনকে দায়ী করছেন গবেষকরা।

অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলছেন, বিশেষ করে ভারতের উজানে পাথর উত্তোলনের ফলে মাটি আলগা হয়ে নদীতে চলে আসে। ফলে নদীর তলদেশ ভরে যায়। সেখানে নাব্য সংকট তৈরি হচ্ছে। সেখানে গাছও কেটে ফেলা হচ্ছে।

এর পাশাপাশি নদীগুলো ঠিকমতো ড্রেজিং না হওয়া, ময়লা-আবর্জনায় নদীর তলদেশ ভরে যাওয়া, ঘরবাড়ি বা নগরায়ণের ফলে জলাভূমি ভরাট হয়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন এই গবেষকরা।

অপরিকল্পিত উন্নয়ন : অধ্যাপক ইসলাম বলছেন, ‘এবারের হঠাৎ বন্যার পেছনে মানুষের নিজেদের তৈরি কত কারণ রয়েছে। সিলেট বা সুনামগঞ্জ এলাকায় আগে ভূমি যে রকম ছিল, নদীতে নাব্য ছিল, এত রাস্তাঘাট ছিল না বা স্থাপনা তৈরি হয়নি। ফলে বন্যার পানি এখন নেমে যেতেও সময় লাগে। আগে হয়তো জলাভূমি, ডোবা থাকায় অনেক স্থানে বন্যার পানি থেকে যেতে পারত। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না।’

হাওরে বিভিন্ন জায়গায় পকেট পকেট আমরা রোড করে ফেলেছি। ফলে পানি প্রবাহে বাধার তৈরি হচ্ছে। শহর এলাকায় বাড়িঘর তৈরির ফলে পানি আর গ্রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে বন্যার তীব্রতা আমরা বেশি অনুভব করছি। এসব কারণে আগাম বন্যা হচ্ছে এবং অনেক তীব্র বন্যা হচ্ছে।

অধ্যাপক ইসলাম বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা তৈরির কারণে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া বন্যার অন্যতম কারণ। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে ইটনা-মিঠামইন সড়কে এই বন্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে, সেভাবে দায়ী করতে রাজি নন অধ্যাপক ইসলাম।

‘আমাদের দেশে উজান থেকে পানি নামে উত্তর থেকে দক্ষিণে। এই রাস্তাটিও কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণে তৈরি। ফলে এটা হয়তো হাওরের পানি প্রবাহের কিছুটা বাধার তৈরি করছে কিন্তু বন্যার এটাই একমাত্র কারণ নয়।’

নদী গবেষক মমিনুল হক সরকার বলছেন, ‘হাওরে যেসব রাস্তা পূর্ব-পশ্চিমে তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোই হাওরের পানি চলাচলে মূল বাধার তৈরি করছে। এ রকম অনেক রাস্তা কোনোরকম পরিকল্পনা ছাড়া তৈরি করা হয়েছে।’

হাওরে যেসব সড়ক বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে তা পরিকল্পিতভাবে হয়নি বলে মনে করছেন অধ্যাপক সাইফুর ইসলাম। সেটা না হওয়ার কারণেই বন্যা এ রকম তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে।

গত জানুয়ারি মাসে জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন যাতে হাওরে এখন থেকে এলিভেটেড বা উড়াল সড়ক করা হয়। কিন্তু শুধু সুনামগঞ্জ জেলার হাওর এলাকায় যেসব সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে তার বেশিরভাগই এখনো ‘অল সিজন’ বা ‘সাবমার্সিবল’ সড়ক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ বা নেত্রকোনা হাওর এলাকায় বেশিরভাগ জনপদে শহর রক্ষা বাঁধ নেই। ফলে কোনো কারণে হাওরে বা নদীতে পানি বাড়তে শুরু করলে তার খুব দ্রুত শহরে বা আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে।

বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলছেন, ‘হাওরে এসব এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয়নি। সেটা করা না হলে বাড়িঘর উঁচু করে তৈরি করতে হবে, আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। সেটাও করা হয়নি। ফলে যখন এভাবে আকস্মিক বন্যা দেখা দিচ্ছে, সেটার ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হচ্ছে।’

চীনসহ অনেক দেশে স্পঞ্জ সিটি তৈরি করা হচ্ছে। এসব শহরে বন্যা হলে সেই পানি শহরের ভেতরেই জমিয়ে রেখে কাজে লাগানোর পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।

কিন্তু এবার বাংলাদেশে যেভাবে আকস্মিকভাবে পানি বৃদ্ধির রেকর্ড ভেঙে বন্যার তৈরি হয়েছে, এ রকম পরিস্থিতিতে বন্যা ঠেকানো খুব কঠিন বলে বলছেন এই বিশেষজ্ঞরা। সূত্র : বিবিসি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close