আহমেদ জামিল, সিলেট

  ১৯ জুন, ২০২২

সিলেট অঞ্চল পানির নিচে

* বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি * সেনাবাহিনীর সঙ্গে উদ্ধার অভিযানে নৌবাহিনী ও ফায়ার ব্রিগেড * বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন সিলেট * রেল যোগাযোগ বন্ধ

টানা বর্ষণ ও অব্যাহত পাহাড়ি ঢলে সিলেটে বেড়েই চলেছে বন্যার পানি। এরই মধ্যে সিলেট নগরী ও অনেক উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানিতে পুরোপুরি ডুবে গেছে। গতকাল শনিবারও টানা বর্ষণে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে সিলেট নগরীর বাকি এলাকা। পুরো সিলেট বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে ট্রেন যোগাযোগ।

এ ছাড়া গতকাল সকালে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, সদর উপজেলাসহ আরো অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর সঙ্গে নৌবাহিনী ও ফায়ার ব্রিগেড সদস্যরা মাঠে নেমেছেন।

গতকাল শসকাল থেকে নৌবাহিনীর ৩৫ জন সদস্য দুটি টিমে বিভক্ত হয়ে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। নৌবাহিনীর সদস্যরা নিজস্ব ক্রুজ ও বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। বিকালে ৬০ জনের আরেকটি দল এবং আরো ক্রুজ ও হেলিকপ্টার উদ্ধার কাজে যুক্ত হয়েছে।

বন্যার পানি ওঠায় পানিতে তলিয়ে গেছে কুমারগাঁও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র। ফলে পুরো সিলেট বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মোবাইল টেলিফোন নেটওয়ার্কও পাচ্ছেন না বন্যাদুর্গতরা। এদিকে ভয়াবহ অবস্থা দেখা দিয়েছে সিলেটের জকিগঞ্জ-কানাইঘাট উপজেলায়। প্রথম দফা বন্যায় সুরমা-কুশিয়ারা নদীর অন্তত ১৫ স্থানে ভেঙে যাওয়া ডাইক মেরামত না করায় ফের ভাঙা অংশ দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। গত শুক্রবার সকাল থেকে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর অন্তত ৫টি স্থান দিয়ে পানি ঢুকছে। গতকাল নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে অনেক এলাকা।

বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন পুরো সিলেট : সিলেট কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্রে বন্যার পানি উঠে যাওয়ায় পুরো সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গতকাল দুপুর সোয়া ১২টার দিকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল কাদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, পানি উঠে যাওয়ায় আপাতত সাবস্টেশনটি বন্ধ করা হয়েছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি পানি সেচে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটি আবার চালু করতে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে এই সাবস্টেশনে পানি উঠতে শুরু করে। গত শুক্রবার দুপুর থেকে এই কেন্দ্র সচল রাখতে যৌথভাবে কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী, বিদ্যুৎ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশন। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারপাশে বাঁধ নির্মাণ করেন তারা। তবে পানি দ্রুত বাড়তে থাকায় বন্ধ করে দিতে হলো উপকেন্দ্রটি।

ভাঙা ডাইক এখন মরণফাঁদ : জকিগঞ্জ-কানাইঘাট উপজেলায় ভয়াবহ অবস্থা দেখা দিয়েছে। প্রথম দফা বন্যায় সুরমা-কুশিয়ারা নদীর অন্তত ১৫ স্থানে ভেঙে যাওয়া ডাইক মেরামত না করায় ফের ভাঙা ডাইক দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে লোকালয়ে। গত শুক্রবার সকাল থেকে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর অন্তত ৫টি স্থান দিয়ে পানি ঢুকছে। গতকাল শনিবার পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে অনেক এলাকা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সুরমা নদীর আটগ্রাম এলাকার মরিচা, নালুহাটি ও বড়বন্দ গ্রামে প্রথম দফায় ভেঙে যাওয়া ডাইক দিয়ে প্রবল বেগে পানি লোকালয়ে ঢুকছে। শুক্রবার সকাল থেকে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মাত্র ১২ ঘণ্টায় নতুন করে প্লাবিত হয়েছে অর্ধশতাধিক গ্রাম। তলিয়ে গেছে গ্রামীণ রাস্তাঘাট।

সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উদ্ধার অভিযানে নৌবাহিনী : সিলেটে বন্যাদুর্গত এলাকায় পানিবন্দি লোকজনকে উদ্ধারে কাজে যোগ দিয়েছে নৌবাহিনী। গতকাল সকাল থেকে নৌবাহিনীর ৩৫ জন সদস্য দুটি টিমে ভাগ হয়ে কাজ শুরু করেছে। সিলেট জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। উদ্ধার কাজে নৌবাহিনী সদস্যরা নিজস্ব ক্রুজ ও বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। বিকালের মধ্যে ৬০ জনের আরেকটি দল এবং আরো ক্রুজ ও হেলিকপ্টার উদ্ধার কাজে যুক্ত হবে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্যের একটি দল শুক্রবার রাতেই সিলেট এসে পৌঁছায়। গতকাল সকাল থেকে ৩৫ সদস্যের দল কোস্টগার্ডের একটি ক্রুজ ও বিমানবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে। সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নে একটি টিম সকাল থেকে কাজ শুরু করে। আরেকটি টিম কোম্পানীগঞ্জে কাজ শুরু করেছে। জেলা প্রশাসন সূত্র আরো জানায়, আরো দুটি ক্রুজ উদ্ধার কাজে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে একটি সিলেটে ও অন্যটি সুনামগঞ্জে উদ্ধার কাজে যুক্ত হবে। এদিকে, সেনাবাহিনীর ৯টি ইউনিট সিলেট ও সুনামগঞ্জে উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গত শুক্রবার বিকাল থেকে তারা সিলেটের ৩টি উপজেলা ও সুনামগঞ্জের ৫টি উপজেলায় উদ্ধার কাজ করছে।

রেকর্ড ভেঙেছে এবার বন্যা : সিলেটে বন্যা দেশের আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বাকি তিন জেলা শহরের কিছু উঁচু স্থান, পাহাড়ি এলাকা এবং ভবন ছাড়া সবখানে এখন পানি। আগামী দুই দিনে এই পানি আরো বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ১৯৯৮ সালের জুন মাসে সিলেট বিভাগে অনেকটা এমন বন্যা হয়েছিল। কিন্তু এরপর বেশির ভাগ বন্যা মূলত হাওর ও সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৯ সালে সুনামগঞ্জ ও সিলেট শহরে দু-তিন দিনের জন্য হঠাৎ বন্যা হয়। কিন্তু পুরো সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ এলাকা প্লাবিত হওয়ার মতো বন্যা হয়নি।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূইয়া বলেন, দেশের একটি বিভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ ডুবে যাওয়ার মতো বন্যা এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। সিলেটে এর আগে যত বন্যা হয়েছে তা মূলত হাওর এলাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এবার গ্রাম, শহর ও উঁচু এলাকা হিসেবে বিবেচিত স্থানগুলোও পানির নিচে চলে গেছে। আর সোমবারের আগে এই পানি নামার সম্ভাবনা কম। কারণ উজানে আগামী দুই দিন অতিভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূ-উপগ্রহভিত্তিক সংস্থা ইসিএমডব্লিউর পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামীকাল বাংলাদেশের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। এর আগে গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে; যা ১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টি। আর গত তিন দিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই অল্প কয়েক দিনে এত বৃষ্টির রেকর্ডও গত ১০০ বছরে নেই।

রানওয়েতে পানি, ফ্লাইট শিডিউল পরিবর্তন

ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে পানি উঠে যাওয়ার কারণে সিলেট-লন্ডন ফ্লাইটের শিডিউলে পরিবর্তন আনা হয়েছে। গতকাল ও আজকের দুটি ফ্লাইট পিছিয়ে আগামী ২১ ও ২৩ তারিখে নেওয়া হয়েছে। গতকাল এ তথ্য জানিয়েছেন সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমদ। তিনি বলেন, শনিবার ও রবিবার সিলেট-লন্ডন রুটে বিমানের দুটি ফ্লাইট ছিল। কিন্তু ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়েতে পানি উঠে যাওয়ায় এসব ফ্লাইট শিডিউল পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৮ তারিখের ফ্লাইট ২১ তারিখ এবং ১৯ তারিখের ফ্লাইট ২৩ তারিখ যাবে। এর আগে শুক্রবার বিকালে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সব ধরনের বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

সিলেট রেলওয়ে স্টেশন বন্ধ ঘোষণা

বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় বিমানবন্দরের পর এবার সিলেট রেলস্টেশনও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও রেলস্টেশন থেকে ট্রেন চলবে। গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে স্টেশন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিলেট রেলস্টেশন ম্যানেজার মো. নুরুল ইসলাম।

তিনি জানান, এরই মধ্যে রেলস্টেশনের মূল প্ল্যাটফরমে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। স্টেশনে কোনো ট্রেন ঢুকতে পারছে না। তাই রেলস্টেশন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে বিকল্প হিসেবে মাইজগাঁও রেলস্টেশন থেকে ট্রেন চলাচল করবে।

সিলেট-সুনামগঞ্জের পর হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ ও নবীগঞ্জে বন্যা দেখা দিয়েছে। কালনী-কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন নদণ্ডনদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। প্রতিনিয়ত প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এরই মধ্যে জেলার দুই উপজেলার অন্তত ৪০টি গ্রামের হাজারো পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তাদের আশ্রয়ণ কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের মধ্যে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। আজমিরীগঞ্জ-পাহারপুর ও আজমিরীগঞ্জ-কাকাইলছেও সড়ক ডুবে যাওয়ায় দুটি ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close