মিজান রহমান

  ২৫ মে, ২০২২

খুলছে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার

বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন স্বপ্ন নয়, বাস্তব। সব প্রস্তুতি শেষ, খুলছে আগামী ২৫ জুন। তাই খুব শিগগিরই দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে গোটা দেশের যোগাযোগব্যবস্থা যেমন সহজ হবে তেমনি গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্প ও সম্ভাবনা। সৃষ্টি হবে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান। জীবনযাত্রার প্রয়োজনে শুরু নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য। এ সেতু শুধু শিল্প খাতেই নয় সুফল পাওয়া যাবে কৃষি খাতে ও পর্যটন খাতে। দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়ন তথা জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন দুয়ার খুলে যাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা নদীর ওপর পুরো পদ্মা সেতু প্রস্তুত হওয়ায় বাংলাদেশ উন্নয়ন এবং অগ্রগতির নতুন যুগে প্রবেশের দারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে তা যে কেবল এই সেতুর আশপাশের জনগণের জীবনমানকে এগিয়ে নেবে তা নয় বরং এটা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পুরো বাংলাদেশের মানুষের জীবনকেই এগিয়ে নেবে। পুরো দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু হবে একটি নতুন মাইলফলক।

সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাব। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও অথনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। যা মানুষের জীবনমানকে আরো উন্নত করবে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে নদী শাসন ছিল বিরাট একটি চ্যালেঞ্জিং এবং জটিল কাজ। একইভাবে পদ্মা নদীর গভীরতা বেশি এবং তলদেশের মাটির কন্ডিশন দুর্বল হওয়ার কারণে নদীর বুকে পাইলিং করে পিলার নির্মাণ করাও ছিল বেশ জটিল এবং কঠিন। ফলে পদ্মা সেতুর টোটাল ডিজাইনটা খুব জটিল ছিল। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনমনীয় দৃঢ়তা সব কঠিন কাজকে সমাধান করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এইসিওএম নামক একটি ডিজাইন কোম্পানি পদ্মা সেতুর ডিজাইন করেছে। নদী শাসনের কাজ করেছে চীনের প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। সেতু নির্মাণের মূল দায়িত্বে রয়েছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়।

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী সেতু। এটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮.১৮ মিটার। এই সেতুতে মোট পিলারের সংখ্যা ৪২টি। প্রতিটি পিলারে ৬টি পাইল রয়েছে এবং নদীর গভীরে সর্বোচ্চ ১২৩ মিটার লম্বা পাইলিং হয়েছে। পাইলিংরে গভীরতার দিক দিয়ে এটি বিশ্বে রেকর্ড করেছে। কারণ নদীর ওপর কোনো সেতু নির্মাণে এত গভীর পাইলিং অতীতে কোথাও করতে হয়নি। মোট ৪২টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যানের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মিত। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১৫০.১২ মিটার। এই সেতুটি স্টিল ট্রাসে নির্মিত এবং তা চীনেই নির্মিত হয়েছে। পদ্মা সেতু হচ্ছে দুই স্তর বিশিষ্ট একটি বহুমুখী সেতু। এর ওপরের স্তর চার লেন বিশিষ্ট সড়ক সেতু এবং নিচের স্তর রেললাইন। ওপরের স্তর দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে এবং নিচের স্তর দিয়ে রেল চলাচল করবে।

৩ কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়নের নতুন এক গতি আনবে : পদ্মা সেতুর এক প্রান্তে মুন্সীগঞ্জ এবং অপর প্রান্তে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা। এই সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বিরামহীন এবং নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের অবারিত এক সুযোগ সৃষ্টি হবে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার মাত্র ৫ থেকে ১০ মিনিট সময়েই এই সেতু পার হওয়া যাবে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার যোগাযোগব্যবস্থায় ব্যাপক গতি আসবে। অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে দীর্ঘদিন ধরে পিছিয়ে পড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনে পদ্মা সেতু বিশাল এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এ সেতু বিশাল এই অঞ্চলের ৩ কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়নের নতুন এক গতি আনবে। মাদারীপুর, শরিয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল এবং পটুয়াখালীসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় শিল্পায়ন এবং পর্যটনের বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, পোলট্রি এবং ডেইরি খাতের উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন এক সুযোগ সৃষ্টি হবে।

এরই মধ্যে পদ্মা সেতুকে ঘিরে দুই পাড়ে জমির মূল্য বেড়ে গেছে। বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা ও অত্যাধুনিক আবাসিক এলাকা স্থাপন হচ্ছে। প্রতিদিনই নির্মাণাধীন সেতুটি দেখতে ভিড় করছেন মানুষ। পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্প বিকাশের পরিকল্পনা নিয়েছে সেতু বিভাগ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। টাকার চলতি মূল্য অনুযায়ী এর আকার ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পদ্মা সেতুর প্রভাবে জিডিপি দেড় শতাংশ বাড়লে অর্থনীতিতে প্রথম বছর সার্বিক অর্থমূল্য বাড়বে ৪১ হাজার ৯৪৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। জিডিপি ১.৩ শতাংশ বাড়লে সার্বিক অর্থনীতিতে ৩৬ হাজার ৩৫২ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার টাকার স্ফীতি ঘটবে। জিডিপি ১.২ শতাংশ বাড়লে টাকার অঙ্কে জিডিপি বাড়বে ৩৩ হাজার ৫৫৬ কোটি ৫৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন এক শতাংশ ধরা হলে আর্থিক মূল্য বাড়বে ২৭ হাজার ৯৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সরকারের এক সম্ভাব্যতা জরিপে বলা হয়, সেতুটি নির্মিত হলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।

দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে পদ্মা সেতু কী ধরনের ভূমিকা রাখবে সে বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতি যুক্ত হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ বেড়ে জাতীয় আয়ে যোগ হবে। কারণ পদ্মা সেতুর সঙ্গে ওই অঞ্চলের অনেক অবকাঠামো উন্নত হচ্ছে। এই সেতুর কারণে আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বেড়ে যাবে। এশীয় হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে এই সেতুর যোগাযোগ। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ বাংলার রাস্তাঘাট, টোলপ্লাজাসহ সবকিছুতে বড় ধরনের উন্নত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এসব উন্নয়ন বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে এবং বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে।

সেতু বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পদ্মা সেতুর বহুমুখী কার্যক্রম নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেতুকে কেন্দ্র করে দুই পাড়ে ২৯ শতাংশ বাড়বে নির্মাণকাজ, সাড়ে ৯ শতাংশ কৃষি কাজের প্রবৃদ্ধি, ৮ শতাংশ বাড়বে উৎপাদন ও পরিবহন খাতের কাজ। এর প্রভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ কোটি লোকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হবে। ফলে পদ্মা নদীর ওপারে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার কমবে ১ শতাংশ। ওই অঞ্চলে দারিদ্র্য কমলে এর প্রভাব পড়বে সারা দেশে। তখন জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যের হার কমবে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। যানবাহন চলাচল যত বাড়বে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ততই বাড়বে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ সেতুর সড়ক ও রেললাইনের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চল এবং অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে ভালো যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। উৎপাদক এবং ভোক্তাদের জন্য পণ্যের ন্যায্যমূল্যও নিশ্চিত হবে। সেতুটি দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়াও এর মাধ্যমে ভারত, নেপাল এবং ভুটানের সঙ্গে একটি সংযোগ তৈরি হতে পারে।

পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্ভাবনার বিষয়ে সেতু বিভাগের সাবেক সচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে জামার্নিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে নিজের আবেগ প্রকাশ করে বলেন, যেদিন এ সেতু নির্মাণ শেষ হবে সেদিনই হবে আমার চাকরি জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। আমি একা একা সেতুর ওপর থেকে হেঁটে আসব। ছুঁয়ে দেখব। আর মনে মনে ভাবব, এ সেতু নির্মাণে আমার পরিশ্রমের কথা।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় পদ্মা সেতুর সংযোজন শেখ হাসিনা সরকারের এক অবিস্মরণীয় অবদান। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সক্ষমতা ইতিহাস হয়ে থাকবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতির চাকাও গতিশীল হবে। দেশি বিনিয়োগের চেয়ে বিদেশি বিনিয়োগ এ অঞ্চলে বেশি আসবে। কৃষি-শিল্প-অর্থনীতি-শিক্ষা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই পদ্মা সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। পদ্মার দুই পারে অর্থনৈতিক জোন গড়ে উঠবে। মোংলা বন্দরে বেশ কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। গার্মেন্টসহ রপ্তানিমুখী নানা ধরনের শিল্প-কারখানাগুলো স্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close