জিয়াউদ্দিন রাজু ও মারুফ আহমেদ, কুমিল্লা

  ২৪ মে, ২০২২

মাঠ হতে পারে উত্তপ্ত!

* আওয়ামী লীগের দুগ্রুপের বিবাদ এবারও দৃশ্যমান * সাক্কু-কায়সারে ভাগ হবে বিএনপির ভোটব্যাংক

আগামী মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই জটিল হচ্ছে ভোটের সমীকরণ। নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে হতে যাওয়া এবারের নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ সরকার ও ইসির জন্য। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে এ নির্বাচন বড় চ্যলেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ গত দুই নির্বাচনে এ সিটিতে জয় পায়নি আওয়ামী লীগ। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এই কুসিক নির্বাচনটি সরকারি দলের জন্য এক ধরনের অগ্নিপরীক্ষা। বিষয়টি এরই মধ্যে ভাবিয়ে তুলেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগকে। কেন্দ্রেও এ নিয়ে তোড়জোড় বেশ। রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে না এলেও স্বতন্ত্রের ব্যানারে মাঠে রয়েছেন গত দুবারের মেয়র বিএনপির সদ্য আজীবন বহিষ্কৃত নেতা মনিরুল হক সাক্কু এবং মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের বহিষ্কৃত সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার।

ফলে স্বতন্ত্রের ব্যানারে বিএনপির দুই নেতা ও আওয়ামী লীগের দুই নেতা মনোনয়ন জমা দেওয়ায় ভোটের মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে এরই মধ্যে। বড় দুই দলের এই চার নেতা নির্বাচনে আসায় এর প্রভাব দলীয় ভোটব্যাংকের পাশাপাশি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ওপরও পড়েছে। একাধিক প্রার্থী থাকায় কোনো প্রার্থীই দলীয় ভোটব্যাংকের সুবিধা পাবেন না বলে মনে করছেন স্থানীয় অনেকেই।

আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতকে উপেক্ষা করে শেষ মুহূর্তে এসে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রযুক্তি উপকমিটির সদস্য মাসুদ পারভেজ খান ইমরান। তিনি প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আফজল খানের ছেলে। এ ছাড়া ইমরান মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য আঞ্জুম সুলতানার ভাই। একই দলের দুই পক্ষের দুই প্রার্থী হওয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়তে পারেন।

পুরোনো দ্বন্দ্ব আবার দৃশ্যমান

কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগে সদর আসনের সংসদ সদস্য হাজি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আফজল খান পরিবারের বিরোধ দীর্ঘদিনের। সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আফজাল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা পেয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। সে নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর কাছে পরাজিত হন তিনি। সে সময় গুঞ্জন উঠে দলীয় নেতাদের অসহযোগিতার কারণে পরাজিত হন তিনি। এবারের নির্বাচনে নৌকা পেতে ১৪ জন দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ করেন। এরই মধ্যে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য আঞ্জুম সুলতানা সীমা ও আফজাল খানের ছেলে ও সীমার ভাই মাসুদ পারভেজ খান ইমরানও ছিলেন। তবে নৌকার মনোনয়ন পান আ ক ম বাহাউদ্দিনের অনুসারী আরফানুল হক রিফাত। এরপরই মনোনয়ন জমার শেষ মুহূর্তে এসে নাটকীয়ভাবে মাসুদ পারভেজ খান ইমরানের মনোনয়ন জমা দেওয়ার ঘটনায় নির্বাচনে উত্তাপ বেড়েছে। কুমিল্লার রাজনীতি-সংশ্লিষ্টদের অভিমত, মাসুদ পারভেজ খানের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে আবার সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন এবং খান গ্রুপের দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান হয়েছে। এ দ্বন্দ্ব যথাসময়ে নিরসন করা না গেলে ভোটের রাজনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে ধারণা রাজনীতি-সংশ্লিষ্টদের।

তবে কুমিল্লায় আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ দাবি করে নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত বলেন, ‘অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। আমাদের কোনো গ্রুপিং নেই। সবাই এক হয়ে কাজ করে নৌকার বিজয় আনব।’

মাসুদ পারভেজ খান ইমরান বলেন, ‘মানুষ কখনো কল্পনাও করেনি তিনি নৌকা মার্কা পাবেন। আমি যেদিন মনোনয়ন জমা দিয়েছি মানুষ সেদিন খুব উৎফল্ল হয়েছে। আমার বিশ্বাস এখন যে পরিবেশ আছে সে পরিবেশ ঠিক থাকলে কুমিল্লার জনগণ আমাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করবে।’

তবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করতে কঠোর বার্তা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রমের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘পূর্বে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে দলীয় কোন্দল কাজ করত, তাই আমাদের কাক্সিক্ষত ফল আসেনি। এবার মহানগর নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। দলীয় নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করাও সহজ হবে। যারা বিদ্রোহী হবেন বা যারা ইন্দন দেবেন তাদের কাউকে আর গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হবে না। এমন নির্দেশনাই দেওয়া আছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের ঐক্যকে গুরুত্ব দিচ্ছি। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। আশা করছি তিনি বসে যাবেন।’

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেছেন, ‘কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ কাজ করলে সাংগঠনিক শাস্তির আওতায় আসতে হবে।’

সাক্কু-কায়সারে ভাগ হতে পারে বিএনপির ভোটব্যাংক

বিএনপি সরাসরি নির্বাচন না করলেও তাদের দুজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা স্বতন্ত্রের ব্যানারে নির্বাচনে আসায় এর প্রভাব পড়বে দলীয় ভোটব্যাংকে। কুমিল্লা মহানগরে বিএনপির রাজনীতি দুই ধারায় বিভক্ত। এক অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন মনিরুল হক সাক্কু, আরেক অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য আমিনুর রশীদ ইয়াসিন। এই ইয়াসিনের শ্যালক হলেন নিজাম উদ্দিন কায়সার। কার্যত এ নির্বাচনে তৃণমূলের গ্রুপিংয়ে নগরীতে বিএনপির ভোটব্যাংকে প্রভাব পড়বে। তবে দলীয় নির্দেশনার বাইরে নির্বাচনে যাওয়ায় সাক্কু-কায়সারকে বহিষ্কার করে তাদের পক্ষে কাজ না করার নির্দেশনা আছে দলের পক্ষ থেকে। এতে বিপাকে পড়েছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। দলীয় নির্দেশনা আছে সাক্কু-কায়সারের পক্ষে নির্বাচনে কাজ না করার, কিন্তু তৃণমূলের নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন তাদের রাজনীতি করেছেন। নির্বাচন নিয়ে নেতাকর্মীদের প্রতি প্রত্যাশা আছে, তবে কেন্দ্রীয় নির্দেশনার কারণে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এখন উভয় সংকটে।

এ নিয়ে কথা হয় মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদ্যবহিষ্কৃত সভাপতি ও স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী নিজাম ?উদ্দিন কায়সারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রার্থী কুমিল্লা সিটিতে একজন, সেটা আমি।’ মনিরুল হক সাক্কুকে উদ্দেশ করে কায়সার বলেন, ‘উনি অনেক আগে থেকেই বিএনপি থেকে আদর্শিকভাবে বিচ্যুত হয়ে গেছে। বিএনপির ভোটব্যাংক বলতে যা বোঝায় এখানে আমি এককভাবে সেটা পাব।’

সিটির দুবারের মেয়র এবং এবারেরও প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ‘কায়সার আমার ছোট ভাই, আমি তার মঙ্গল কামনা করি। ভোটের রাজনীতি আর সংগঠন এক বিষয় না, সে এটা উপলব্ধি করুক। আমি এসব নিয়ে মোটেও বিচলিত নই। আমার প্রতিটি নির্বাচনে তৃণমূলকর্মীরা আমার বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এবারও বিজয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।’

এই চার প্রার্থীর বাইরে মেয়র পদে নির্বাচন করছেন আরো দুজন প্রার্থী। তারা হচ্ছেন ইসলামী আন্দোলনের রাশেদুল ইসলাম, নাগরিক কমিটির কামরুল আহসান বাবুল (স্বতন্ত্র)। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের নির্দিষ্ট একটি ভোটব্যাংক রয়েছে।

এদিকে ১৯ মে যাচাই-বাছাই শেষে মেয়র পদে ৬ জনসহ কাউন্সিলর পদে ১১১ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৩৭ জনের মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করা হয়। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে বাদপড়া ১০ কাউন্সিলর প্রার্থীর ৯ জন প্রার্থিতা ফিরে পেতে আপিল করেছেন। আপিল আবেদনের শেষদিন রবিবার রাতে গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন রিটার্নিং অফিসার শাহেদুন্নবী চৌধুরী। তিনি জানান, মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়া ১০ প্রার্থীর মধ্যে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের একজন কাউন্সিলর প্রার্থী ছাড়া সবাই আপিল করেছেন। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে আপিল শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ২৬ মে, প্রতীক বরাদ্দ ২৭ মে এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৫ জুন। কুমিল্লা সিটির তৃতীয় এ নির্বাচনে ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ সিটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন। তাদের মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ১৭ হাজার ৯২ জন। পুরুষ ভোটার ১ লাখ ১২ হাজার ৮২৬ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন দুজন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close