নিজস্ব প্রতিবেদক
দ্রুত ছড়াচ্ছে মাঙ্কিপক্স
বন্দরে সতর্কতা স্বাস্থ্য পরীক্ষার নির্দেশ
করোনাভাইরাস মহামারির রেশ না কাটতেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ‘মাঙ্কিপক্স’ নামে এক ভয়ংকর ভাইরাস। প্রতিদিনই বাড়ছে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ। বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত এই ভাইরাস হানা না দিলেও ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত ১২টি দেশে আক্রান্ত হয়েছেন ৯২ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) সতর্কবার্তা, আফ্রিকা থেকে ইউরোপ এবং আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়া মাঙ্কিপক্সে আরো আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা আছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সব বন্দরে সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
গতকাল রবিবার অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক নাজমুল ইসলামের সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে- আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে মাঙ্কিপক্সের রোগী শনাক্ত হয়েছে। মাঙ্কিপক্স নতুন কোনো রোগ নয়। তবে আগে এ ধরনের রোগী পশ্চিম আফ্রিকা বা মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোয় এন্ডেমিক হিসেবে ধরা হয়। আগে শুধু পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোয় ভ্রমণকারীদের বা বাসিন্দাদের মধ্যে শনাক্ত হয়েছে এ রোগ। সম্প্রতি এসব দেশ ভ্রমণের ইতিহাস নেই ইউরোপ ও আমেরিকায় বসবাসকারী এমন ব্যক্তিদের মধ্যে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে। ফলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, সিলেটের সিভিল সার্জন এবং আন্তর্জাতিক বন্দর আছে- এমন জেলার সিভিল সার্জনদের।
শাহজালাল বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহরিয়ার সাজ্জাদ বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মাঙ্কিপক্স-সংক্রান্ত নির্দেশনার চিঠিটি তারা পেয়েছেন। চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী বিমানবন্দরে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক যাত্রী স্ক্যানারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ অসুস্থ বা সংক্রমিত হয়েছেন সন্দেহ হলে তাকে মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল রেফার করা হবে। তবে এখন পর্যন্ত তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঙ্কিপক্স এক বিশেষ ধরনের বসন্ত। জলবসন্ত বা গুটিবসন্ত তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পরিচিত। তাই প্রতিকারও অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু এই মাঙ্কিপক্স ভাইরাসটি এতই বিরল যে এখনো পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্তদের সুস্থ করতে নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি চিকিৎসকদের জানা নেই।
মূলত পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার কিছু দেশে এই ভাইরাসের হদিস মিলত। কিন্তু সেটাই এখন ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ এবং আমেরিকা মহাদেশে। তবে মানুষের মধ্যে সহজে মাঙ্কিপক্স ছড়ায় না। করোনাভাইরাসের মতো অত দ্রুত সংক্রামকও নয়।
পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার নিরক্ষীয় বনাঞ্চলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। মাঙ্কিপক্স দুই ধরনের হয়ে থাকে- মধ্য আফ্রিকান এবং পশ্চিম আফ্রিকান। এই রোগের প্রাথমিক উপসর্গ হচ্ছে জ্বর, মাথাব্যথা, হাড়ের জয়েন্ট এবং মাংসপেশিতে ব্যথা এবং দেহে অবসাদ। জ্বর শুরু হওয়ার পর দেহে গুটি দেখা দেয়। এসব গুটি শুরুতে দেখা দেয় মুখে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে হাত এবং পায়ের পাতাসহ দেহের সব জায়গায়।
এই গুটির জন্য রোগী দেহে খুব চুলকানি হয়। পরে গুটি থেকে ক্ষত দেখা দেয়। গুটি বসন্তের মতোই রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেও দেহে এসব ক্ষত চিহ্ন রয়ে যায়। সংক্রমিত রোগীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ থেকে এই ভাইরাস ছড়ায়। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে, ত্বকের ক্ষত থেকে এবং নাক, মুখ ও চোখের ভেতর দিয়ে এই ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বানর, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, এমনকি মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগীর ব্যবহৃত বিছানাপত্র থেকেও এই ভাইরাস অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ভাইরাসের প্রভাব বেশ মৃদু। এর বৈশিষ্ট্য জল বসন্তের মতোই এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এই ভাইরাসের কোনো চিকিৎসা নেই। তবে যেকোনো প্রাদুর্ভাবের মতোই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে এর প্রকোপ রোধ করা যায়। গুটি বসন্তের টিকা ৮৫ শতাংশ কার্যকর বলে দেখা গেছে। মাঙ্কিপক্সের জন্য এখন এই টিকাই ব্যবহার করা হচ্ছে।
যেভাবে সংক্রমিত হয় : কোনো সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলে মাঙ্কিপক্স ছড়াতে পারে। ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করে ভঙ্গুর ত্বক, শ্বাসনালি, চোখ, নাক বা মুখের মাধ্যমে। যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে আগে এমনটা বলা না হলেও এখন ধারণা করা হচ্ছে, যৌন মিলনের সময় সরাসরি সংস্পর্শে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে। সংক্রমিত বানর, ইঁদুর ও কাঠবিড়াল এবং ভাইরাসযুক্ত বস্তু যেমন বিছানাপত্র ও জামাকাপড়ের সংস্পর্শে এলেও ছড়াতে পারে ভাইরাসটি।
এদিকে, মাঙ্কিপক্স মোকাবিলায় বাংলাদেশের কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন।
তারা মাঙ্কিপক্স ভাইরাস মোকাবিলায় সচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। সে সঙ্গে কারো শরীরে বসন্ত রোগের উপসর্গ দেখা গেলে হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। হাসপাতালগুলোকে রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানোর কথা বলেছেন। দেশের বাইরে থেকে আসা যাত্রীদের বিমানবন্দরে ভালোভাবে পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন।
অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, মাঙ্কিপক্স নাক দিয়ে ঢোকে। এই ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলে তার সংস্পর্শে যাওয়া যাবে না। ভাইরাসটি মোকাবিলায় মাস্ক পরতে হবে, বারবার হাত ধুতে হবে। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে যেসব নিয়মকানুন মানা হয়, মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রেও একই ধরনের নিয়ম মানতে হবে। বিমানবন্দরগুলোতে কারো মধ্যে মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ দেখা দিলে তাকে অন্তত ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে।
মাঙ্কিপক্স সম্পর্কে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, মাঙ্কিপক্স থেকে সেরে উঠতে ২ থেকে ৪ সপ্তাহ লাগে। ভাইরাসটি প্রতিরোধে যারা বাইরের দেশ থেকে বিশেষ করে যারা আফ্রিকার দেশ থেকে আসছেন, তাদের প্রতি নজর রাখতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে। এই ভাইরাসটি এখনো গবেষণা পর্যায়ে আছে। তাই বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
ড. মুশতাক হোসেন বলেন, বাংলাদেশে ভাইরাসটি চলে এসেছে কি না সেটি খোঁজার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। তবে, চিকেনপক্স (জলবসন্ত) কোনো রোগী পাওয়া গেলে আইইডিসিআর বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে খবর দিতে হবে। সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি হিসেবে মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এগুলো চালিয়ে যেতে হবে। এটি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। তবে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। মাঙ্কিপক্সের সরাসরি কোনো চিকিৎসা নেই। কেউ আক্রান্ত হলে তাকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। তার সংস্পর্শে যাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে এই রোগী পাওয়া গেলে তারপর ব্যাপক প্রচারে যেতে হবে।
"