নিজস্ব প্রতিবেদক ও চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ১০ মে, ২০২২

তেল নিয়ে তেলেসমাতি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ‘পুঁজি করে’ রাজধানীসহ সারা দেশে ভোজ্য তেল নিয়ে তেলেসমাতি কারবারে মেতে উঠেছেন ব্যবসায়ী আর মিল মালিকরা। সরকারের হুশিয়ারি, নজরদারি এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানের মধ্যেও থামছে না তাদের অনৈতিক কারবার। ফলে ভোক্তাকে বেশ ভোগাচ্ছে ভোজ্য তেল। নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের পেছনে দফায় দফায় খরচ বাড়ছে মানুষের। এক বছর আগে ১০০ টাকায় যে পরিমাণ তেল পাওয়া যেত, বর্তমানে সেই পরিমাণ তেল কিনতে খরচ হচ্ছে ২২০ টাকা। এত খরচ বাড়ার পরও বাজারে সংকট দেখিয়ে তেল লুকিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। দোকানে না মিললেও তেল পাওয়া যাচ্ছে ব্যবসায়ীর গুদাম কিংবা ঘরে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে এই অবস্থায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, স্থানীয় বাজারে ভোজ্য তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করায় ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করা ভুল ছিল। তবে যারা তেলের সংকট তৈরি করেছেন তারা চিহ্নিত হয়েছেন। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ভোজ্য তেলের বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন তিনি। এ সময় ভোজ্য তেলের উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা ছিলেন।

মন্ত্রী বলেন, রমজানে স্থানীয় বাজারে ভোজ্য তেলের দাম না বাড়ানোর জন্য বলেছিলাম ব্যবসায়ীদের। সে সময় তাদের স্থানীয় বাজারে ভোজ্য তেলের দাম ঠিক রাখার দরকার ছিল। তবে ব্যবসায়ীরা রমজানে ভোজ্য তেলের দাম না বাড়ালেও ঈদুল ফিতরের পরপরই অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়িয়েছেন। তারা ভোজ্য তেলের দাম প্রতি লিটারে ৩৮ টাকা বাড়িয়েছেন। কিন্তু রমজানে ভোজ্য তেলের দাম বাড়লে এটা এতটা বাড়ত না।

মন্ত্রী মত প্রকাশ করেন, ব্যবসায়ীদের একটি অংশ সময়ের সুযোগ নিয়ে অধিক লাভের জন্য ভোজ্য তেল মজুদ করে। তিনি জানান, বাজারে ভোজ্যতেলের স্থিতিশীল সরবরাহ বজায় রাখার প্রয়োজনে তার মন্ত্রণালয় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সহায়তা নেবে।

আগামীতে তেলের দাম বাড়বে কিনা এমন প্রশ্নে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক বাজার মনিটর করব। আশপাশের দেশগুলো দেখে বিবেচনা করব সবকিছু। যতদূর দাম কমানো যায় তার চেষ্টা করব। এলসি কত দামে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ক্লিয়ার করল সেটা ধরে তেলের দাম নির্ধারণ হয়। আজকে ২৫০ টাকা হয়েছে সেটা ধরে কিন্তু দাম নির্ধারণ হচ্ছে না। আজকের দামে যদি ফিক্স করতাম তাহলে গতকাল টনপ্রতি তেলের দাম ছিল ১৯৫০ ডলার।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের প্রশংসা করে মন্ত্রী বলেন, ভোক্তা অধিকার আমাদের সাহায্য করছে। এত হাজার হাজার ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছানো মুশকিল। যেখানে যেখানে সম্ভব আমরা চেষ্টা করছি।

তেলের সংকট তৈরি করা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, খুচরা পর্যায়ে কিন্তু কাজটি করেছে। আমাদের ভোক্তা অধিকার যেখানেই এ ধরনের ঘটনা পাচ্ছে তাদের জরিমানা-মামলা করছে। আমরা অ্যাসোসিয়েশনকে বলেছি তাদেরও ব্যবস্থা নিতে হবে। মিল মালিকদেরও করতে হবে মনিটরিং। কোন কোন জায়গায় এ ধরনের ডিলার আছে তাদের ডিলারশিপ বাতিল করতে পারেন। আইনগতভাবে যেখানে যেটা দরকার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

এ সময় বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ, টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান, তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

পরে সংবাদ সম্মেলনে সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি এবং বাজারে তেল সংকটের জন্য মিল মালিকরা দায়ী নন বলে দাবি করেন সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, তেল বাজারে আছে, বাজার থেকে তেল শেষ হয়ে যায়নি। হঠাৎ করে ৫ তারিখ তেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে খুচরা বিক্রেতারা ক্রাইসিস সৃষ্টি করেছে।

এদিকে, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ১৫ হাজার লিটার সয়াবিন তেল অবৈধ মজুদ রাখায় ও অতিরিক্ত দামে বিক্রির অভিযোগে তিন প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার করে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। র‌্যাব-৩ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের যৌথ অভিযানে এ জরিমানা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান তিনটা হলো- অদ্বিতি ট্রেডার্স, মেসার্স সিফাত ট্রেডিং ও মেসার্স মিন্টু স্টোর।

র‌্যাব-৩ এর সহকারী পরিচালক (অপস ও ইন্ট শাখা) বীণা রানী দাস বলেন, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেশি দামে সয়াবিন তেল বিক্রির অভিযোগ ছিল। এ ছাড়া তারা অতিরিক্ত তেল মজুদ রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছিলেন। তিনটি দোকান থেকে প্রায় ৭৫ ড্রাম সয়াবিন তেলের মজুদ পাওয়া গেছে। জরিমানার পাশাপাশি মজুদ রাখা তেল সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রির নির্দেশ দেওয়া হয় দোকানিদের।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিস প্রধান মো. আবদুুল জব্বার মণ্ডল অভিযান শেষে বলেন, ‘ক্রয়-বিক্রয়ের পাকা রসিদ সংরক্ষণ না করা, পুরোনো রেটের তেল মজুদ করে নির্ধারিত বাজারমূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে খোলা সয়াবিন বিক্রির অপরাধে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।’

এছাড়া চট্টগ্রামে দু’দিনে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করা হয়েছে। গতকাল সোমবার চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বাজারের এক মুদি দোকানির গুদামে ১৫ হাজার লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সিরাজ সওদাগরের তিনটি গুদামে মজুদ তেলের সন্ধান পায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ সময় তালাবদ্ধ গুদাম থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত ১৫ হাজার লিটার তেল জব্দ করা হয়।

জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজউল্লাহ বলেন, তালাবদ্ধ গুদাম থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত ১৫ হাজার লিটার তেল জব্দ করা হয়েছে এবং এক লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

এর আগে রবিবার দুপুরে নগরীর ষোলশহরে কর্ণফুলী মার্কেটের ‘মেসার্স খাজা স্টোরে’ অভিযান চালিয়ে গোপন কুঠুরি থেকে এক হাজার ৫০ লিটার তেল জব্দ করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এর আগের রাতে ফটিকছড়ির বাগানবাজার এলাকার দক্ষিণ গজারিয়া গ্রামে মুদি দোকানি আকতার হোসেনের বাড়ি থেকে ২ হাজার ৩২৮ লিটার তেল জব্দ করে স্থানীয় প্রশাসন।

তবে এসব গতানুগতিক অভিযানের পরিবর্তে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে মামলা ও গ্রেপ্তার করে বিচারের দাবি জানিয়েছে বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সংগঠন ‘কনসাস কনজুমার্স সোসাইটি’ (সিসিএস)।

এক বিবৃতিতে সিসিএসের নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, ঈদুল ফিতরের পর সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বৃদ্ধির পরও বাজারে তেলের সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তদারকিতে বিভিন্ন ডিলার ও ব্যবসায়ীদের গোপনে মজুদ করা তেল উদ্ধার হচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয়, ভোজ্য তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে ভোক্তা সাধারণকে জিম্মি করে অতিরিক্ত মূল্য আদায় করা হচ্ছে। এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় কৃত্রিম সংকট এখন সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে বলে দাবি করে সংগঠনটি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close