আরমান ভূঁইয়া

  ২৯ জানুয়ারি, ২০২২

বিশেষজ্ঞদের অভিমত

ডাক্তার ছাড়া কান পরিষ্কার মারাত্মক ক্ষতিকর

* কান পরিষ্কারের ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নষ্ট হয় * পর্দা ফাটা, ফাঙ্গাস ও ইনফেকশন হতে পারে

মানুষের শরীরের সংবেদনশীল অঙ্গগুলোর মধ্যে কান অন্যতম। কানের ময়লা পরিষ্কার করা কিংবা কান খোঁচানোর কারণে কানের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া পর্দা ফেটে যাওয়া, ফাঙ্গাসসহ নানা রোগ সৃষ্টি করে। অনেক সময় ইনফেকশন হয়ে চুলকানি-ব্যথা, রক্ত-পুঁজ ও কান স্তব্ধ হতে পারে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কান পরিষ্কার করা মারাত্মক ক্ষতিকর বলছেন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞরা।

প্রায় সময় রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার ও টার্মিনালগুলোতে ‘মোবাইল ইএনটি চিকিৎসক’ দেখা যায়। যারা কান পরিষ্কার ও কানের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া এসব চিকিৎসায় কানে সমস্যাজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রাস্তায় যারা কানের চিকিৎসা ও কান পরিষ্কার করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানিক কোনো জ্ঞান নেই। তা ছাড়া কান পরিষ্কার করা অত্যন্ত ভয়াবহ।

নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘কানে হালকা হলদে ও তৈলযুক্ত ময়লার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় তা শুকিয়ে শুকনা ময়লাতে পরিণত হয়। এটি কানের জন্য একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ও শরীরের প্রতিরক্ষারই অংশ। ১৫ দিন পর পর কানের চামড়া পরিবর্তন হয়। সে সঙ্গে কানের ময়লাও পরিষ্কার হয়ে যায়।’

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা যায়, রাস্তা-ঘাটে কান পরিষ্কার ও কানের চিকিৎসা করেন একদল কানের ‘ডাক্তার বা মোবাইল ইএনটি চিকিৎসক’। তারা মানুষের কান পরিষ্কার করাসহ কানে ব্যথা, চুলকানি ও রক্ত-পুঁজ জমাট রোগীদের চিকিৎসা করান। প্রয়োজনে রোগীদের কানে ব্যবহারের জন্য মানহীন অজানা কিছু ওষুধ দিয়ে থাকেন। এমন চিকিৎসার বিনিময়ে ২০ টাকা থেকে ৫০০ টাকাও রাখেন রাস্তার এসব ডাক্তার।

রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় প্রায় ১৫ বছর ধরে ঘুরে ঘুরে কানের চিকিৎসা করে আসছেন মো. লোকমান সরদার। কিশোর বয়সে বাপণ্ডদাদার কাছ থেকে রপ্ত করছেন এই পেশা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে প্রায় চার যুগ ধরে এই কাজ করে আসছেন তিনি। প্রতিষ্ঠানিক কোনো জ্ঞান না থাকলেও কানের চিকিৎসায় কোনো সমস্যা হয় না বলে দাবি তার। লোকমান সরদার বলেন, ‘কানের ভেতরে সাবানের পানি, শ্যাম্পুর পানি, ধুলাবালি ও নানা কারণে কানে ময়লা জমে। এ জন্য কানে ব্যথা, কান স্তব্ধ হয়ে যায়, ফাঙ্গাস ও ইনফেকশন হয়ে পুঁজ বের হয়। মূলত ময়লার কারণেই সমস্যাটা বেশি হয়।’

লোকমান সরদার আরো বলেন, ‘যাদের কানে ময়লা বা পুঁজ থাকে তাদের স্যাভলন-পানি ও হাইড্রোজেন পারক্সাইড দিয়ে কান ওয়াশ করে দেই। যাদের কান স্তব্ধ, ফাঙ্গাস ও ইনফেকশন হয়ে পুঁজ জমে থাকে, তাদের কর্ণ সেবা নামে একটি ওষুধ দিয়ে থাকি।’ এই ওষুধ মানসম্মত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনো কেউ খারাপ বলেনি।’

লোকমানের মতো আরেক মোবাইল ডাক্তার আকবর আলী। তিনি পল্টন, গুলিস্তান ও মতিঝিল এলাকায় ঘুরে ঘুরে কানের চিকিৎসা করান। আকবর আলী বলেন, ‘আমরা ড্রেসিং করে কানের ময়লা ও পুঁজ পরিষ্কার করি। কানে ময়লার কারণে অনেক সময় কান বন্ধ হয়ে থাকে, চুলকায় ও কান ব্যথা করে। কান পরিষ্কার করলে ভালো লাগে আরাম পাওয়া যায়। লোকমান-আকবরে মতো এমন হাজারও মোবাইল ইএনটি ডাক্তার রয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যাদের ভুল চিকিৎসায় দিন দিন কানের সমস্যাজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।’ বিশেষজ্ঞরা বলেন, কান পরিষ্কার করা অত্যন্ত ভংকর। যা কানের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে কানের নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে, কান পরিষ্কার করতে গিয়ে কানের পর্দা ফাটার ঘটনাই বেশি ঘটে।

জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘মানুষের শরীরের সংবেদনশীল অঙ্গগুলোর মধ্যে কান অন্যতম। কানে হালকা হলদে ও তৈলাক্ত ময়লা হয়। যা অনেক সময়ে শুকিয়ে চাকা ময়লাতে পরিণত হতে পারে। তবে, এর জন্য কান পরিষ্কারের প্রয়োজন নেই। প্রতি ১৫ দিন পরপর কানের চামড়া পরিবর্তন হয়। সে সঙ্গে কানের ময়লাও পরিষ্কার হয়ে যায়। এটি একটি স্বভাবিক প্রক্রিয়া ও কানের প্রতিরক্ষারই অংশ। কান পরিষ্কারের মাধ্যমে এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নষ্ট হওয়াসহ কানের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে কান পরিষ্কার করতে গিয়ে কানের পর্দা ছিদ্র হয়ে ঘটতে পারে ভয়াবহ সমস্যা।’

এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরে অধ্যাপক ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, কানের ভেতরে পাইলোসেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড থেকে নির্গত সেরুমিনই হচ্ছে এই খইল বা ‘ময়লা’, যা ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের আক্রমণ থেকে কানকে সুরক্ষিত রাখে। এটা আসলে আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষারই অংশ। এর ফলে কানের ভেতরে কোনো ধরনের পোকামাকড় কানে ঢুকতে গেলেও এই খইল বাধা সৃষ্টি করে। ১৫ দিন পরপর কানের চামড়া পরিবর্তন হয়। সে সঙ্গে এসব ময়লা বা খইলও পরিষ্কার হয়ে যায়।’

অধ্যাপক ডা. মাহমুদুল হাসান আরো বলেন, ‘কানের মধ্যে অনেক সময় ফাঙ্গাস এবং ক্ষত হয়। সাধারণত কান খোঁচানো বা পরিষ্কার করার জন্য কানের মধ্যে ফাঙ্গাস হয়ে থাকে। কানে ফাঙ্গাস হলে মূলত কান চুলকায়। ইনফেকশন বেড়ে প্রদাহ হলে ব্যথা হয়, পুঁজ ও কান স্তব্ধ হয়ে থাকে। অনেক সময় কানের ভেতরে ক্ষত হয়ে ফাঙ্গাসের সঙ্গে কানের বাইরের পথটিতে ক্ষত সৃষ্টি হলে ব্যথা গুরুতর আকার ধারণ করে। তবে দ্রুত চিকিৎসায় এমন সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।’ কানের যেকোনো সমস্যায় দ্রুত সরকারি হাসপাতাল অথবা এমবিবিএস চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আহ্বার জানান অধ্যাপক ডা. মাহমুদুল হাসান।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close