সিলেট প্রতিনিধি

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২২

১৬৩ ঘণ্টা পর অনশন ভাঙলেন শাবি শিক্ষার্থীরা

উচ্চমহল থেকে দাবি মানার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে : জাফর ইকবাল

উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশনের ১৬৩ ঘণ্টা পর অনশন ভেঙেছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল বুধবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে তাদের অনশন ভাঙান দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হক। দাবি আদায়ে সরকারের উচ্চমহলের বার্তা নিয়ে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের আশ্বাসেই অবশেষে অনশন ভেঙেছেন তারা।

এর আগে গত ১৯ জানুয়ারি বিশ্বদ্যিালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে অনশন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। টানা এক সপ্তাহের অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তারা। মঙ্গলবার গভীর রাতে ঢাকা থেকে ক্যাম্পাসে যান জনপ্রিয় লেখক জাফর ইকবাল। ওই সময় সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী ইয়াসমিন হক। পরে তার আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা অনশন ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। গতকাল বুধবার সকাল ১০টায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের অ্যাম্বুলেন্স যোগে নিয়ে আসা হয় ক্যাম্পাসে। পরে সকাল ১০টা ২০ মিনিটে পানি পান করিয়ে শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙান অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী। এ সময় শিক্ষার্থীরা আবেগ আপ্লুত হয়ে কেঁদে ওঠেন। তাদের সান্ত¦না দেন সাবেক দুই অধ্যাপক।

অনশন ভাঙানোর পর অধ্যাপক জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক যখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে, তখন শিক্ষকদের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত ছিল যে, খবরদার! তোমরা এটা করতে পারবা না। একজন শিক্ষকও সেটা করেননি। একজন শিক্ষকের এ রকম মেরুদণ্ডহীন হওয়ার কোনো কারণ নেই।’

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সারা বাংলাদেশের সমস্ত তরুণ প্রজন্ম তোমাদের পেছনে। সমস্ত মানুষ তোমাদের পেছনে। তোমরা সুস্থ হও। উদাহরণ তৈরি করো। যে উদাহরণ বাংলাদেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে উদাহরণ অনুসরণ করবে।’

উপাচার্যের অপসারণ-সংক্রান্ত দাবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সরকার যখন দাবি-দাওয়া মেনে নেবে বলেছে, তখন দাবির মধ্যে এই দাবিটাও তো পড়ে। কিন্তু সরকারেরও তো নিজস্ব টেকনিক্যাল ব্যাপার থাকে, রাজনৈতিক ব্যাপার থাকে, সেটার জন্য তাদের হয়তো একটা প্রসেস থাকে। গোপালগঞ্জের ভাইস চ্যান্সেলরকে তারা এককভাবে সরিয়েছে, অন্য ভাইস চ্যান্সেলরকে অন্যভাবে সরিয়েছে। কাজেই সেটা তাদের ব্যাপার। আমার প্রাইমারি কনসার্ন ছিল, ওদের অনশন থেকে বের করতে পারি কি না।’

আন্দোলনে বহিরাগতদের ইন্ধন প্রসঙ্গে জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি দেখেছি যে, এরা সাধারণ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে কোনো উচ্চভিলাষ নেই। পুলিশ ওদের গায়ে এ রকম নির্মমভাবে হাত তুলেছে, কাজেই ওদের মনের ভেতর একটা ক্ষোভ হয়েছে, সংগত কারণেই। সেজন্যই তারা এই আন্দোলনটা করছে। এর মধ্যে বিন্দুমাত্র বাড়াবাড়ি নেই, অহেতুক কোনো দাবি নেই। ওদের দাবি শতভাগ যৌক্তিক।’

উপাচার্যকে উদ্দেশ করে জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি তিন বছর আগে যখন নাকি অবসরে চলে যাই, তখন একটা চিঠি লিখে উনাকে দিয়ে যাই। সেই চিঠিতে আমি বলে দিয়েছিলাম অনেকগুলো। আমি সেখানে লিখেছিলাম স্পষ্ট করে, আপনি যদি এগুলো না করেন, ছাত্রদের এখন যে ক্ষোভ আছে, তা বিক্ষোভে রূপ নেবে। একদম অক্ষরে অক্ষরে আমার কথাটা ফলেছে।’

শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে ‘দানব’ বলেছেন। সেই ‘দানবের’ কাছে আপনারা শিক্ষার্থীদের রেখে যাচ্ছেন। এই বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ‘শুনেন, ছাত্রদের আন্ডার ইস্টিমেট করবেন না। কে, কাকে, কার কাছে রেখে যাচ্ছি, সেটা সময়েই বলে দেবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আজ উচ্চপর্যায়ের এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আমার বাসায় আলোচনা হয়েছে। তারা বাসায় এসেছিলেন। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে আলোচনার পর আমরা দেরি করিনি; সরাসরি এখানে চলে এসেছি। আমরা নিশ্চিত হয়েই এসেছি যে তাদের দাবি পূরণ হবে।’

জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি তাদের অনুরোধ করব, তারা আমাকে যে কথা দিয়েছেন সে কথাগুলো যেন রক্ষা করেন। আমি আর এই ছাত্রদের ভেতর কোনো পার্থক্য নেই। আমাকে যে কথাটা দিয়েছেন তা যদি রক্ষা করা না হয়, তাহলে বুঝে নেব তারা শুধু ছাত্রদের সঙ্গে নয়, আমার সঙ্গে এবং এই দেশের যত প্রগতিশীল মানুষ আছে সবার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। কাজেই আমি আশা করব তারা যেন আমাকে যে কথা দিয়েছেন সে কথাগুলো রাখেন।’ উপাচার্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষকের এ রকম মেরুদণ্ডহীন হওয়ার কোনো কারণ নেই। আসলে তিনি অ্যাকাডেমি বুঝেন না।’

উপাচার্য ফরিদের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষার্থীদের অনশন করার দরকার নেই জানিয়ে জাফর ইকবাল বলেন, ‘এই আন্দোলনের জন্য অনশন করার দরকার নেই। কারণ যে মানুষটার জন্য তারা অনশন করে যাচ্ছেন, তার জন্য প্রাণ দেওয়া সমীচীন না।’

এ সময় অধ্যাপক ইয়াসমিন বলেন, ‘স্টুডেন্টদের গায়ে পুলিশ হাত দেবে, কিন্তু টিচার কিছু বলবেন না, টিচার হিসেবে আমার কাছে এর কোনো মাফ নেই। টিচার হওয়ার জন্য আমার যে ক্ষমতা এতে পুলিশ এলে কিন্তু কিচ্ছু করবে না। আমি একজন শিক্ষক। আমি পুলিশ আর স্টুডেন্টদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আমি একদম শকড। আমি অসম্ভব শকড। আমি এই শকড কবে কাটিয়ে উঠব, জানি না।’

এদিকে জাফর ইকবালের আশ্বাসে অনশন ভাঙলেও উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে যাচ্ছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল বুধবার সকালে অনশন ভেঙে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম অপূর্ব বলেন, ‘অধ্যাপক জাফর ইকবাল আমাদের কাছে খুব সম্মানিত। আমরা তাকে বিশ্বাস করি। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, আমাদের দাবি পূরণের ব্যাপারে সরকারের উচ্চমহল থেকে তাকে আশ্বাস দিয়েছে। আশা করছি, সরকার তাকে দেওয়া এই আশ্বাস রাখবে।’

অপূর্ব আরো বলেন, ‘অনশন থেকে সরে এলেও আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। উপাচার্যের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। দ্রুতই নিজেরা বসে আমরা আন্দোলনের ধরন ও কর্মসূচি ঠিক করব। সেটি হতে পারে অবস্থান কর্মসূচি, মশাল মিছিল বা বিক্ষোভ মিছিল। তবে যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে তা আমরা মতবিনিময় করেই করব।’

গত ১৩ জানুয়ারি তিন দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। এরপর গত ১৬ জানুয়ারি বিকালে তিন দফা দাবি আদায়ে উপাচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে অবরুদ্ধ করেন তারা। পরে পুলিশ উপাচার্যকে উদ্ধার করতে গেলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই সময় পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। পুলিশ ৩০০ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। এরপর থেকে ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে টানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এর অংশ হিসেবে গত ১৯ জানুয়ারি থেকে আমরণ অনশন শুরু করেছিলেন শিক্ষার্থীরা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close