বদরুল আলম মজুমদার

  ২৫ জানুয়ারি, ২০২২

বিএনপিতে অসন্তোষ

পরীক্ষিতরা সাইড লাইনে

দলে ‘চেইন অব কমান্ড’ বা শৃঙ্খলা ফেরাতে পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেন্দ্র করে পরীক্ষিত নেতাদের ছাঁটাই চলছে বিএনপিতে। তবে এই ছাঁটাইকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে অসন্তোষ। এতে আগামী দিনে রাজপথের আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা বাস্তবায়নে রয়েছে সমন্বয়হীনতা। দীর্ঘদিন মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার পর হঠাৎ তাদের সরিয়ে দেওয়ায় বাড়ছে ক্ষোভ ও হতাশা। কেউ কেউ এ বহিষ্কার ও অব্যাহতির পেছনে ষড়যন্ত্রও দেখছেন। হাইকমান্ডকে ভুল বুঝিয়ে দলের একটি অংশ এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে কাজ করছে।

তবে দলের হাইকমান্ড মনে করছে, দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় এ ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করছে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যত বড় নেতা হন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না- সারা দেশে নেতাকর্মীদের এমন একটা বার্তা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। কিন্তু তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে তৃণমূলে ছিল অস্পষ্টতা। তারা মনে করেন, দলীয় কোনো নেতাকর্মী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না বলে কেন্দ্র থেকে এমন স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়নি।

নীতিনির্ধারকদের অনেকে বলেছেন, দল কোনো মনোনয়ন দেবে না। তবে কেউ যদি নিজের ইচ্ছায় ভোট করতে চান তাতে বাধাও দেবে না। কেন্দ্রের এমন সিদ্ধান্তের কারণে কয়েক দফা ইউপি নির্বাচনে দলের অনেক নেতাকর্মীই প্রার্থী হন। তাদের অনেকে চেয়ারম্যানও হন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দল কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়নি। এমন পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে অংশ নেন সদ্য বহিষ্কৃত অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। নির্বাচন চলাকালে তাকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ভোটের পর তৈমূরের সঙ্গে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামালকেও করা হয় বহিষ্কার। তাদের দুজনকে বহিষ্কার করা নিয়ে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন।

তৈমূর ও কামালকে বহিষ্কার করায় বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। তারা মনে করেন, তৈমূরের মতো নেতা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছেন তিনি। হঠাৎ করে এমন একজন পরীক্ষিত নেতাকে বহিষ্কার করা উচিত হয়নি।

বহিষ্কারের বিষয়ে তৈমূর আলম খন্দকার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের বহিষ্কারে তৃণমূলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না তা সময় বলে দেবে। আগামী দিনে এ জেলায় কীভাবে আন্দোলন হবে তা একমাত্র আল্লাহ বলতে পারবেন। তবে আমাকে ও কামালকে বহিষ্কার করায় নারায়ণগঞ্জের নেতাকর্মীরা মর্মাহত। আমি বিএনপিকে অত্যন্ত ভালোবাসি। আমার মেয়ে আমার ভাই-ভাতিজা-ভাগিনা সবাই বিএনপি করে। আমি বিএনপি ছেড়ে কোথায় যাব। এই বিএনপির জন্য গুলিবিদ্ধ হয়েছি, জেল খেটেছি। আমাকে রাজপথে গরুর মতো পেটানো হয়েছে, তবু আমি খালেদা জিয়ার ব্যানার ছাড়িনি।’

একই মন্তব্য করেন বহিষ্কৃত নেতা কামালও। তিনি বলেন, ‘আমরা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করেছি, এটা সত্যি। অনেক সময় তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভুল হতে পারে। কিন্তু সেই ভুল শোধরানোর একটা সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। কারণ দীর্ঘদিন আমরা এ দলের পেছনে শ্রম দিয়েছি। বিনিময়ে শেষ সময়ে এসে তার পুরস্কার পেলাম।’

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দল একটা নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। কেউ যদি

শৃঙ্খলা না মানে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ কাজ করলে তাকে তো দলের আদর্শিক নেতা বলা যায় না।

নির্বাচনের পাশাপাশি দল পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। বরিশাল জেলা ও মহানগরের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন মজিবুর রহমান সরোয়ারের আধিপত্য ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সরোয়ারকে বাদ দেওয়ায় জেলা ও মহানগর নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলছেন না।

একই অবস্থা রাজশাহীতেও। মহানগর বিএনপি থেকে হঠাৎ করে সরিয়ে দেওয়া হয় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকেও। এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ দুই মহানগরের প্রভাবশালী নেতাদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর প্রকাশ্যে কোনো ক্ষোভ দেখা না গেলেও খুলনায় নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে বাদ দেওয়ায় নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে বিক্ষোভ করেন। এমনকি মঞ্জু নিজেও কেন্দ্র ঘোষিত কমিটি মেনে নিতে পারেননি। খুলনা জেলা ও মহানগরের কমিটি পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। দলের সিদ্ধান্ত না মানায় তাকে শোকজ করা হয়। সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে শোকজের জবাব দেন তিনি। তবে নিজের ভুল স্বীকার না করে আগের অবস্থানে অটল থাকায় ক্ষুব্ধ হয় হাইকমান্ড। পরে তাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কেন্দ্রের এমন সিদ্ধান্তের পর খুলনা জেলা ও মহানগর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পাঁচ শতাধিক নেতা একযোগে দল থেকে পদত্যাগ করেন।

বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ‘দলের হাইকমান্ড যা কিছু করছেন সবই দলের স্বার্থে। তিনি উপলব্ধি করছেন এখন তরুণদের সামনে আনা দরকার, সেজন্য এমনটি করা হচ্ছে।’

এ ছাড়া সম্প্রতি পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় নোয়াখালী পৌরসভা বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ আবু নাছের, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুল ইসলাম কিরণ, নাটোর পৌর বিএনপির আহ্বায়ক শেখ এমদাদুল হক মামুন (এমদাদ), নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শরিফুল ইসলাম লেলিন (ভিপি লেলিন) ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক আমিরুল ইসলাম জামালকেও তার পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। দলীয় নির্দেশ লঙ্ঘন করে পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় নোয়াখালী ও নাটোরের এ পাঁচ নেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কুমিল্লা সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে দল থেকে বহিষ্কার করায় প্রশ্ন ওঠে দলে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close