গাজী শাহনেওয়াজ

  ২১ জানুয়ারি, ২০২২

সংক্রমণ বাড়ছে, রোগীদের ভোগান্তির আশঙ্কা

প্রাণসংহারি নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাপ বাড়তে শুরু হয়েছে হাসপাতালগুলোতে। হাসপাতালে চাপ বাড়লে আক্রান্ত রোগীদের বাড়বে ভোগান্তি। তার চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য সিট পাবেন না। সংকট দেখা দেবে চিকিৎসা সরঞ্জামের।

এদিকে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের তাণ্ডবের মধ্যেই দেশে প্রতিদিনই শনাক্ত রোগী এবং শনাক্তের হার আগের দিনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। এতে হাসপাতালে গিয়েও দরকারি চিকিৎসা না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়তে পারেন কোভিড রোগীরা। এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।

১২ জানুয়ারি নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছেন ২ হাজার ৯১৬ জন। আর এ সময়ে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে (১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ)। আর দেশে মহামারির দুই বছরের মাথায় এসে নতুন শনাক্ত হওয়া ২ হাজার ৯১৬ জনকে নিয়ে দেশে শনাক্ত রোগী ১৬ লাখ ছাড়িয়ে গেল। ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজন করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হন বলে জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এর ঠিক ১০ দিন পর আক্রান্ত প্রথম রোগীর মৃত্যুর কথা জানানো হয়। সেই থেকে করোনার ঊর্ধ্বমুখী-নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্যে দেশে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটের সময় গত বছর জুলাই-আগস্টে দৈনিক শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এরপর সেটা নামতে নামতে জুলাইয়ে ২ শতাংশের নিচে চলে আসে।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে বিশ্বে শুরু হয় ওমিক্রনের তাণ্ডব। ৩ জানুয়ারি দৈনিক শনাক্তের হার ৩ শতাংশ এবং ৫ জানুয়ারি তা ৪ শতাংশ ছাড়ায়। কিন্তু এর দুই দিনের মাথায় ৭ জানুয়ারি শনাক্তের হার ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে হয় ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ৯ জানুয়ারি শনাক্তের হার দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর পরদিন ১০ জানুয়ারি শনাক্তের হার হয় ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ, ১১ জানুয়ারি ছিল ৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এর ঠিক এক দিনের মাথায় শনাক্তের হার গিয়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। আর গত বুধবার এক লাফে সাড়ে নয় হাজার শনাক্ত হয়। গতকাল দেশে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় নতুন করে শনাক্ত হয়েছে ১০ হাজার ৮৮৮ জন। শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৩৭ শতাংশে। এভাবেই প্রতিদিনই বাড়ছে।

ওমিক্রন মৃদু বলে সাধারণ মানুষের কাছে বার্তা গেলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ওমিক্রনকে মৃদু ভাবা ঠিক হবে না। বিশ্বজুড়ে ওমিক্রনের তাণ্ডবের পর বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। দেশে এখন পর্যন্ত ওমিক্রনের ৩৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে এত দিন কেবল ঢাকার রোগী থাকলেও যশোরেও ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে বিবাহসহ সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ রাখার আহ্বান জানান।

এদিকে দেশে আগের সপ্তাহের তুলনায় গত এক সপ্তাহে করোনা রোগী বেড়েছে ১৬৯ শতাংশ। কয়েক দিন ধরেই করোনার সংক্রমণে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। আর এ পরিস্থিতিকে ‘অ্যালার্মিং’ (বিপজ্জনক) বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, ‘পুরো ডিসেম্বরে শনাক্ত হয়েছে ৪ হাজার ৫৮৮ জন, আর ১৯ জানুয়ারি এক দিনেই সাড়ে ৯ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছে। ওমিক্রনের পাশাপাশি ডেল্টা ভাইরাসও কিন্তু অবস্থান করছে। সংক্রমণ হঠাৎ করে মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে ধরে নিতে হবে নতুন ভ্যারিয়েন্টেই সংক্রমণ বেশি হচ্ছে।

করোনায় যদি এভাবে রোগী বাড়তে থাকে, তাহলে সেটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে জানাচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। হাসপাতালের বেড সংকট, চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ফলে ফের দেশের ডেল্টা পরিস্থিতির মতো অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যদি রোগী সংখ্যা তিন থেকে চার গুণ হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু খুব বেকায়দায় পড়তে হবে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘আমরা ২০ হাজার বেড প্রস্তুত করেছিলাম। রোগী যদি দিনে ১ লাখ হয়, তাহলে কোথায় থাকবে? প্রতিটি দেশের একটা সক্ষমতা আছে। আমরা যতই সক্ষমতা বাড়াই সবকিছুর একটা শেষসীমা আছে।’

দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের চাপ বেড়েছে। সেখানে সাধারণ রোগীদের ভর্তি নেওয়া অনেকটাই বন্ধ হওয়ার পথে। রোগী বাড়ছে অন্যান্য হাসপাতালেও। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ২৫০ শয?্যার টিবি হাসপাতালে গতকাল বৃহস্পতিবার ভর্তি হয়েছে আটজন। প্রতিদিনই রোগী বাড়ছে বলে জানান হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আয়েশা আক্তার। তিনি বলেন, ‘ওমিক্রনে আক্রান্ত বেশি হলেও ভয়াবহ না। তবে আমরা সতর্ক থাকছি।’

রোগী বাড়লে হাসপাতালসহ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ পড়বে জানিয়ে আইইডিসিআর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ওমিক্রনে গুরুতর রোগী সংখ্যা কম হচ্ছে। কিন্তু ওমিক্রনে যদি মোট রোগী সংখ্যা বাড়ে, তাহলে গুরুতর রোগীর সংখ্যাও আনুপাতিক হারে বাড়বে। আর গুরুতর রোগী ছাড়া যে হাসপাতালে রোগী যাবে না বা যায় না, তাতো নয়। যারা বয়স্ক, যারা আগে থেকেই অন্য রোগে আক্রান্ত, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারা তো অবশ্যই হাসপাতালে যাবেন। ফর প্রিকোশান, ফর মনিটরিং উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের দেশেও অনেক রোগী হয়ে গেলে হাসপাতাল ব্যবস্থা সংকটে পড়বে।’

ওমিক্রন দ্রুত ও অধিক সংক্রমণশীল হওয়ায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ পড়তে বাধ্য বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী। ওমিক্রন কতটা ছড়াচ্ছে, সেটা দেশের প্রতিদিনের সরকারি হিসাব থেকেই টের পাওয়া যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যদিও আমি বিশ্বাস করি এর বাইরেও অসংখ্য রোগী রয়েছে।’

লেলিন চৌধুরী বলেন, দেশে এখনো করোনা রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর হার কম। কিন্তু আশঙ্কার কথা হচ্ছে, যেকোনো সময়ে এটা বেড়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হার্ট ডিজিস ও ক্যানসারের মতো যারা জটিল রোগে আক্রান্ত, তারাও কিন্তু এতে সংক্রমিত হবেন। আর তাদের ক্ষেত্রে এটা মারাত্মক হবে। তখন তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা লাগবে, তাদের ছাড়াও হাসপাতালে যাবে অসংখ্য মানুষ। সে ক্ষেত্রে হাসপাতালের ওপর আবার চাপ বাড়বে, ডেল্টার সময়ের মতো আইসিইউর চাহিদা বাড়বে। এতে করে রোগীদের দরকারি সেবা ও চিকিৎসা দিতে গিয়ে ডাক্তার, নার্স ও হাসপাতালের অন্য কর্মীরা হিমশিম খাবেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close