এস এইচ এম তরিকুল, রাজশাহী

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২২

অপরিকল্পিত পুকুর খননে কমেছে আবাদি জমি

রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গত বছরের মতো আবারও শুরু হয়েছে সিন্ডিকেট পরিচালিত অপরিকল্পিত পুকুর খনন কার্যক্রম। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় সিন্ডিকেটের সদস্যরা পরিকল্পিতভাবেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এই খননযজ্ঞ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে চোর-পুলিশ খেলায় বিভিন্ন কারণে অভিযান চালিয়েও তাদের ধরতে পারছে না প্রশাসন। ফলে জেলা প্রশাসনের কাছে পুকুর খনন বন্ধে আবেদন করেও সুফল পাচ্ছেন না এলাকাবাসী। আর পুকুর খননের কারণে একের পর এক ফসলি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। গত এক দশকে আবাদযোগ্য জমি কমেছে তিন হাজার হেক্টরেরও বেশি। এর একটি বড় অংশ চলে গেছে বাণিজ্যিক পুকুর খননে। তাই রাজনৈতিক জবাবদিহিতা ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া এ পুকুর খননের কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে মতামত দিয়েছেন এলাকাবাসী।

সরেজমিনে গত এক সপ্তাহে রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে দেখা গেছে, এক প্রকার জোরেশোরেই আবারও শুরু হয়েছে অপরিকল্পিত পুকুর খননযজ্ঞ। তবে এসব স্থানে অভিযোগ পেয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তারা দিনের বেলায় গিয়ে নিষেধ করে এলেও রাতের বেলায় ঠিকই চলছে খনন কাজ। আর অভিযানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কখনো কখনো খনন কাজে ব্যবহৃত মেশিন অকেজো করেও আসছেন। কিন্তু তা লোক দেখানো বলেও অভিমত দিচ্ছেন এলাকাবাসী। এ চিত্র রাজশাহীর প্রায় উপজেলাতেই। তবে বিশেষ করে পবা, মোহনপুর, পুঠিয়া, দুর্গাপুর, বাগমারা, গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলায় একেবারে খোলামেলাভাবে চলছে পুকুর খনন কার্যক্রম। এই অপরিকল্পিত পুকুর খনন কার্যক্রম সিন্ডিকেটের সঙ্গে অসাধু কিছু সাংবাদিক নামধারীরাও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

সরেজমিনে পবা উপজেলার মাঠে গিয়ে দেখা যায়, অনেক মাঠেই তিন ফসলি জমিতে শুরু হয়েছে সংস্কারের নামে মাটি বিক্রির জন্য পুকুর খনন। এতে পুকুর খনন বন্ধে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনে আবেদন দিয়েও ফলাফল শূন্যই থেকে যাচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে আবেদনকারীরা একদিকে পড়ছে বিপাকে অন্যদিকে খননকারীরা হচ্ছে উৎসাহিত। এতে করে কমে যাচ্ছে খাদ্য উৎপাদন, হুমকিতে পড়েছে পরিবেশ। তবে রাজশাহীতে গত পাঁচ বছরে বাণিজ্যিক মাছের খামার বেড়েছে বহুগুণ। আর কমেছে চারণভূমি। যে কারণে সংকট বেড়ে যাওয়ায় পশু খাদ্যের দাম বেড়েছে প্রায় চার থেকে পাঁচ গুণ।পরিদর্শনকালে পবা উপজেলার বাগধানি, কর্তহার ছাড়াও দর্শনপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে, জোরেশোরে চলছে পুকুর খনন। তবে তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এসব খননযজ্ঞ চালাচ্ছে।

এর প্রেক্ষিতে গত ৯ জানুয়ারি অবৈধ পুকুর খনন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের কাছে দাখিল করা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন পবা উপজেলার দর্শনপাড়া ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান শাহাদৎ হোসেন সাব্বির নিজেই। ওই আবেদন থেকে জানা যায়, দারুশা এলাকার মৃত হারুনার রশিদ ওরফে হারানের ছেলে পুকুর খনন সিন্ডিকেটের প্রধান মিনারুল ইসলাম বিগত কয়েক বছর থেকে কর্তহার ও এর আশপাশের বিল এলাকায় পরিবেশ ও রাস্তাঘাট নষ্ট করে অবৈধভাবে খননযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে তিনি নতুনভাবে কর্তহার গুচ্ছগ্রামের পাশে ১২৫ বিঘাসহ আরো কয়েকটি পুকুর খনন করছে, যা জেলা প্রশাসকের নির্দেশে উপজেলা প্রশাসন থেকে অভিযান চালানোর পরেও দিন-রাত পুকুর খনন চালিয়ে যাচ্ছে সে। আর এর সঙ্গে জড়িত আছে নগরীর কয়েরদাঁড়া এলাকার মৃত আবদুস সামাদের ছেলে আবদুল লতিফ বাবু।

এদিকে পুকুর খননের পর মাছ চাষে যে লাভ হবে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হচ্ছে কৃষিজীবী ও পরিবেশের। যে কারণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের মধ্যে থাকা অসাধুদের পাশাপাশি সবার মাঝেই জনসচেতনতা বৃদ্ধি খুবই জরুরি বলে মনে করছেন সচেতনমহল ও পরিবেশবাদীরা।

জানা গেছে, রাজশাহী জেলায় বাণিজ্যিক মাছের খামার বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। আর মাছের উৎপাদন বাড়ায় এটিকে সাফল্য হিসেবে দেখছে মৎস্য দপ্তর। আর এই সাফল্যই সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে কৃষিজীবীদের। শুধু অপরিকল্পিত পুকুর খননের জন্যই রাজশাহী জেলার বিভিন্ন ফসলের মাঠে দেখা দিয়েছে জমির প্রকৃতি পরিবর্তন, দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা, পুকুর খননে মাটি বহনে গ্রামীণ রাস্তা নষ্ট, ফসল উৎপাদন ব্যাহত, বিলের পানি বেরুনোর নালা (খাল, ড্রেনেজ) ব্যবস্থা না থাকায় গ্রামের বাড়িঘরে জলাবদ্ধতা, কৃষিজীবীদের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী নষ্ট, কৃষিকাজ না থাকায় যুবসমাজ মাদকে আসক্ত হচ্ছে এবং সর্বোপরি নগরীতে ভাসমান শ্রমিক বাড়ছে। অপরিকল্পিত পুকুর খননের ফলে এসব না সূচক ও নেতিবাচক প্রভাব দেখেও অজানা কারণে নিশ্চুপ আছে প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। এ কারণে তাদের প্রতি সচেতনমহল, পরিবেশবাদী ও ভুক্তভোগীরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবেই দোষারোপ করে আসছে।

তবে আবাদি জমিতেই বাণিজ্যিকভাবে এসব পুকুর খনন হয়েছে স্বীকার করে এ বিষয়ে স্থানীয় কৃষি দপ্তর বলছে, অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননে জলাবদ্ধতায় প্রতি বছরই ব্যাপক ফসলহানি হচ্ছে। ফসলহানির পরিমাণ প্রতি বছরই অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। পরিবেশের ওপর বাড়ছে চাপ। এছাড়াও ফসল রোপণের আগেই ডুবে যাচ্ছে খননকৃত এলাকা।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এ জেলায় মোট জমির পরিমাণ ২ লাখ ৪২ হাজার ৯৩১ হেক্টর। গত ২০০৭-০৮ সালে এ জেলায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৯১ হাজার ৭৮০ হেক্টর। এখন আবাদযোগ্য জমি রয়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৮ হেক্টর। আর গত এক দশকে আবাদযোগ্য জমি কমেছে ৩ হাজার হেক্টরেরও বেশি। এর একটি বড় অংশ চলে গেছে বাণিজ্যিক পুকুর খননে। পরের বছরগুলোর চিত্র আরো ভয়াবহ। সচেতন মহল ও বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক হিসাব করলে প্রায় পুকুর ঘেরের জন্য কৃষি জমি নষ্টে ১০ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে আবাদযোগ্য জমিতে পুকুর খননের সুযোগ নেই। তারপরও এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি বিভিন্ন কৌশলে পুকুর খনন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিল ও নিচু এলাকাগুলোতে অনাবাদি কিংবা এক ফসলি দেখিয়ে এ কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। মুনাফালোভীরা সেই সুযোগটিই নিচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, মৎস্য খামারিরা সাধারণত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জমি বছরমেয়াদি লিজ নিচ্ছেন, কাউকে জমি বিক্রি করতেও বাধ্য করছেন। তাছাড়া জলাবদ্ধতার কারণে চাষাবাদ না হওয়ায় চাষিরাও জমি লিজ অথবা বিক্রি করছেন। এক্ষেত্রে পুকুর খনন করে পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা রাখছেন না খামারিরা। ফলে বর্ষায় জলাবদ্ধতায় ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। কৃষকরা বলছেন, ফসলি জমি কেটে আসলে পুকুর হচ্ছে না, বরং ঘের হচ্ছে। মাত্র চার থেকে পাঁচ ফুট খনন করা হচ্ছে। কিন্তু পুকুর করতে হলে অন্তত ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর করে খনন করতে হয়। কিন্তু খামারে খনন হচ্ছে মাত্র ৫ থেকে ৮ ফুট।

পবা উপজেলার শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পুকুর খনন চলছে। তিনি বলেন, আগে এসব জমি ছিল জমিদারদের দখলে, নীলকরদের দখলে। কিন্তু বর্তমানে এখানকার কৃষি জমি অলিখিতভাবেই চলে গেছে পুকুর খননকারীদের দখলে। এক্ষেত্রে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নীরব ভূমিকা পালন করায় পুকুর খননকারীরা উৎসাহিত হচ্ছে। আর সর্ষের ভেতর ভূত থাকলে প্রশাসনের পক্ষে এমন নাটকীয় অভিযান চালিয়ে পুকুর খনন রোধ সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন এই শিক্ষক।

এ বিষয়ে বাগমারা, দুর্গাপুর, বাঘা ও পুঠিয়া উপজেলার একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিলে নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যে থাকছে। আবার কোনো ঘের মালিক হাই কোর্টে রিট করে পুকুর খনন করছে। এতে অনেকগুলো ঝুঁকি থাকলেও প্রশাসন উদ্যোগ নিচ্ছে না। পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মদদে পুকুর খননের হিড়িক চলছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা যদি মনে করেন নিজ নিজ এলাকায় এই অপরিকল্পিত পুকুর খনন করতে দিবেন না, তবে কখনোই পুকুর খনন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়ন পরিষদ সাাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল বারী ভুলু জানান, কয়েক বছরে তার ইউনিয়নের অর্ধেক আবাদি জমি পুকুরে চলে গেছে। যেটুকু জমি অবশিষ্ট ছিল নতুনভাবে তাতেও চলতে শুরু করেছে খননযন্ত্র। অপরিকল্পিত পুকুর খননে জলাবদ্ধতায় ফসলহানিসহ জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে কৃষিবিদ ছামশুল হক বলেন, অধিকাংশ পুকুর খনন করা হয়েছে নিষ্কাশন নালা, এমনকি ব্রিজ-কালভার্টের মুখে। এতে হালকা বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু ফসল নষ্টই নয়, পুকুর খনন বেশি হওয়ায় গ্রামে গৃহপালিত প্রাণীও কমে যাচ্ছে। চারণভূমি সংকটে মানুষ গরু, মহিষ ও ছাগল প্রতিপালনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে।

এ বিষয়ে কথা বলতে রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের দপ্তরে গেলে তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় তা সম্ভব হয়নি। তবে পবা উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি শেখ এহসান উদ্দীন বলেন, পারিলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বড়ভালাম এলাকায় অভিযান চালিয়ে স্বপন ও রফিকের পুকুর খনন কাজ বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি কর্তহার বিলে মিনারুলের খনন করা পুকুরেও অভিযান চালিয়ে দুটি এস্কেভেটর মেশিন বিকল করা হয়েছে। প্রশাসন এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close