নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১১ জানুয়ারি, ২০২২

করোনা নিয়ন্ত্রণে ১১ বিধিনিষেধ

দেশে করোনা পরিস্থিতি কিছুদিন আগেও নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এক সপ্তাহ ধরে দ্রুত অবনতি হচ্ছে। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার আরো বেড়েছে ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী পরপর দুই সপ্তাহ এই হার ৫ শতাংশের বেশি হলেই তৃতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ নিশ্চিত হয়ে যাবে। দেশে করোনাভাইরাসের তৃতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠার মধ্যে মানুষের চলাচলে চতুর্থবারের মতো ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করেছে সরকার। পরিস্থিতি বিবেচনা করে আরো কঠোর বিধিনিষেধ জারি হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

গতকাল সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা বিধিনিষেধে বলা হয়েছে, জনসাধারণকে অবশ্যই বাইরে গেলে মাস্ক পরতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিতে সারা দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণ ও আবাসিক হোটেলে থাকার জন্য অবশ্যই টিকা সনদ দেখাতে হবে। ১৩ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই ১১ দফা মেনে চলতে হবে। নির্দেশনাগুলো হলো : ১. দোকান, শপিং মল ও বাজারে ক্রেতাণ্ডবিক্রেতা এবং হোটেল-রেস্তোরাঁসহ সব জনসমাগমস্থলে বাধ্যতামূলক সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। অন্যথায় তাকে আইনানুগ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। ২. অফিস-আদালতসহ ঘরের বাইরে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ব্যত্যয় রোধে সারা দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। ৩. রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণ এবং আবাসিক হোটেলে থাকার জন্য অবশ্যই করোনার টিকা সনদ প্রদর্শন করতে হবে।

৪. ১২ বছরের বেশি বয়সি সব শিক্ষার্থীকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত তারিখের পর টিকা সনদ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। ৫. স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরে স্ক্রিনিংয়ের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পোর্টগুলোতে ক্রুদের জাহাজের বাইরে আসার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। স্থলবন্দরগুলোতেও আসা ট্রাকের সঙ্গে শুধু ড্রাইভার থাকতে পারবে। কোনো সহকারী আসতে পারবে না। বিদেশগামীদের সঙ্গে আসা দর্শনার্থীদের বিমানবন্দরে প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। ৬. ট্রেন, বাস ও লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নেওয়া যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কার্যকারিতার তারিখসহ সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করবে। সর্ব ধরনের যানের চালক ও সহকারীদের আবশ্যিকভাবে কোভিড-১৯ টিকা সনদধারী হতে হবে। ৭. বিদেশ থেকে আসা যাত্রীসহ সবাইকে বাধ্যতামূলক কোভিড-১৯ টিকা সনদ প্রদর্শন করতে হবে। ৮. স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন এবং মাস্ক পরার বিষয়ে সব মসজিদে জুমার নামাজের খুতবায় ইমামরা সংশ্লিষ্টদের সচেতন করবেন। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। ৯. সর্বসাধারণের করোনার টিকা এবং বুস্টার ডোজ গ্রহণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় প্রচার এবং উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে তারা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সহায়তা গ্রহণ করবে। ১০. উন্মুক্ত স্থানে সর্বসামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং সমাবেশ-পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হবে। ১১. কোনো এলাকার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সে ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিতে পারবে।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, আগামী মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে সংক্রমণ ফের বাড়তে পারে। এদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, ‘করোনা সংক্রমণ চার শ গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশে এরই মধ্যেই করোনার অতিসংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওমিক্রনের ক্লাস্টার ট্রান্সমিশন হয়েছে ঢাকায় এবং সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে সারা দেশে ডেল্টার মতো ওমিক্রনও ছড়িয়ে পড়তে সময় নেবে না। আর এ আশঙ্কা থেকে গত ৩ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, সিদ্ধান্তগুলো আগামী ১৫ দিনের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হবে।

এদিকে, ৭ জানুয়ারি ওমিক্রনের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণে শঙ্কা প্রকাশ করে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়সহ সব ধরনের জনসমাগম বন্ধের সুপারিশ করেছে করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। নিজেদের সুপারিশের পাশাপাশি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের ওপরও জোর দেয় কমিটি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ২০২০ সালে করোনার প্রকোপের শুরুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে দেরি করে। তখন দেশের বাইরে থেকে আসা রোগীদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যেটা ছিল দেশজুড়ে করোনা ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম ভুল সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের মতো দেশে হোম আইসোলেশন বা হোম কোয়ারেন্টাইন কার্যকর হতে পারে না। সেই সঙ্গে গত বছর ডেল্টার সংক্রমণ ঠেকাতেও সরকার পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব করেছে। এ কারণে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে পুরো দেশে ডেল্টা ছড়িয়েছে। অথচ তখন যদি সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর সঠিক ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেত তাহলে লকডাউনের মতো কঠোর বিধিনিষেধের কবলে দেশকে পড়তে হতো না।

এবারও সেই আশঙ্কার কথা বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ঢাকায় এরই মধ্যে ওমিক্রনের ক্লাস্টার টান্সমিশন হয়েছে। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থ না নেওয়া হলে সারা দেশে আবার এটা ছড়িয়ে পড়বে। আর ডেল্টার চেয়ে তিন থেকে পাঁচ গুণ বেশি সংক্রমণশীল এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়লে সেখান থেকে ফেরত আসা কঠিন হবে।

জনস্বাস্থ্যবিদ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘সংক্রমণের হার বাড়ছে। ওমিক্রন দ্রুত ছড়াচ্ছে। আমাদের সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ দেওয়া উচিত। প্রতিরোধের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা শুধু আশার বাণীই শুনছি।’

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘সংক্রমণ প্রতিদিন বাড়ছে। অথচ নির্বাচনসহ সব ধরনের গণজমায়েত চলছে।’ তিনি বলেন, ‘ডেল্টার সময় আমরা ছড়ানোর পর ব্যবস্থা নিয়েছি। এবার তো ওমিক্রন ধরা পড়ল, সেভাবে এখনো ছড়ায়নি; তাই আমাদের এখনই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এখানে কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয়।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close