সংসদ প্রতিবেদক

  ২৫ নভেম্বর, ২০২১

সংসদে রাষ্ট্রপতি

রাজনীতিকদের শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি গড়তে হবে

রাজনৈতিক নেতাদের পরমতসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে প্রয়োজন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবার মধ্যে ঐক্য। ঐক্য গড়ে তুলতে হবে সাম্প্রদায়িকতা, অগণতান্ত্রিকতা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে।

গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভাষণ দেন তিনি। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এই অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি প্রবেশের আগেই সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অধিকাংশ সংসদ সদস্য উপস্থিত হন। তবে অসুস্থতার কারণে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়াসহ কয়েকজন অনুপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতির প্রতি সম্মান জানান। এরপর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। পরে স্পিকারের পাশে রাখা আসনে বসে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি।

প্রায় আধঘণ্টার ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। এখন পৃথিবীর যে ১১টি দেশকে ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য ‘উদীয়মান এগারো’ বলে অভিহিত করা হয়, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তাই আসুন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে জাতির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ও দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার মধ্য দিয়ে লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলার আধুনিক রূপ ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ কোনো স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশন সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারসহ চাঞ্চল্যকর অন্য মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দুর্নীতি, মাদক, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কারণে দেশে স্বস্তি বিরাজ করছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দল-মত নির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতারা, সুশীলসমাজ এবং অংশীজনদের সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

জলবায়ু পরিবর্তনরোধে জলবায়ু দুর্বলতাসমূহকে, জলবায়ু সমৃদ্ধিতে রূপান্তর করতে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ গ্রহণ করা হয়েছে জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাকে সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত করলেও থামিয়ে দিতে পারেনি। সরকারের সময়োচিত ও দূরদর্শী পদক্ষেপের কারণে অনেক উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ এবং সংক্রমণজনিত মৃত্যুর হার অপেক্ষাকৃত কম। এরই মধ্যে ৪ কোটি ৫৫ লাখ ৯১ হাজার ৫৭৮ জনকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে। করোনার সংকট মোকাবিলায় অর্থনীতিকে দ্রুত পুনর্গঠন এবং এর গতি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সরকার ২৮টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে। করোনাকালে বিনা মূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, ওএমএস কার্যক্রম এবং নগদ অর্থ বিতরণ ইত্যাদি নানামুখী জনকল্যাণকর কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের একটি মানুষও না খেয়ে থাকেনি।

রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতি হিসেবে আমরা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত অতিক্রম করছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর সোপান বেয়ে আমরা পৌঁছে গিয়েছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর স্বর্ণতোরণে। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণ সমাপ্তির পথে। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় মনোবল, বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হয়েছে। এ সেতুর বাস্তবায়ন জাতি হিসেবে আমাদের স্বকীয়তা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা, সক্ষমতা, জবাবদিহি, দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতীকস্বরূপ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস দিয়েছে।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ হচ্ছে। সারা দেশে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ হচ্ছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিজয় দিবসের উপহার হিসেবে দেশের জনগণ প্রথম মেট্রোরেলে চলাচল করতে পারবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সফলভাবে উৎক্ষেপণ করেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এমডিজির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এসডিজির বিভিন্ন সূচকে অনন্য অগ্রগতির স্বীকৃতিস্বরূপ সম্প্রতি বাংলাদেশ ‘এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, এমডিজি অর্জনে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন, বিশেষ করে শিশুমৃত্যু হ্রাসের কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘ কর্তৃক এমডিজি পুরস্কারে ভূষিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় আমাদের গড় আয়ু ছিল ৪৭, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ বছরের ওপরে। প্রাথমিক স্কুলে যাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় শতভাগ। সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে। আমাদের উৎপাদিত পোশাক, সিমেন্ট, ওষুধ, ফুল, সবজি, মাছসহ অসংখ্য পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। পোশাক রপ্তানিতে এবং ইন্টারনেটভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্য উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০০৫ সালে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ, সেখানে ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ আজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, দুর্নীতি ও শোষণহীন এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘বাংলার মানুষের মুক্তি’ অর্থাৎ সোনার বাংলা বিনির্মাণ। সেই লক্ষ্য অর্জনে তার সুযোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান। এখন উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রয়োজন চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে, পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা, ব্যাপক শিল্পায়ন, অর্থনীতি সুসংহতকরণ, সুষ্ঠু অবকাঠামো এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাসহ মেধাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ। এ লক্ষ্যে সবাইকে নিরলসভাবে কাজ করার আহ্বান জানাই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close