আরমান ভূঁইয়া

  ২৪ নভেম্বর, ২০২১

প্রতারণার নতুন ফাঁদ ‘মাইন্ড কন্ট্রোল ড্রাগ’

* হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সবকিছু দিয়ে দেন ভুক্তভোগীরা * হাতিয়ে নিচ্ছে গাড়ি, টাকা ও স্বর্ণালংকার

সনিয়া আক্তার মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় পরিচিত কণ্ঠে পেছন থেকে এক নারী তাকে ডাক দিলেন। পেছনে ফিরতে হঠাৎ এক লোক তার মুখের সামনে একটি কাপড়ের রুমাল উড়ালেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন নারী তাকে একটি চিরটুক হাতে দেয়। এর মধ্যেই তিনি বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেন। চক্রের সদস্যদের কথামতো সনিয়া স্বর্ণের বালা, গলার চেইন, কানের দুল ও মোবাইল দিয়ে দেন।

অজ্ঞান পার্টি বা মলম পার্টি কৌশল বদলে এভাবেই প্রতারণা করছে। আর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে ‘মাইন্ড কন্ট্রোল ড্রাগ’। এটি ‘ডেভিলস ব্রেথ’ বা শয়তানের শ্বাস বা স্কোপোলামিন হিসেবেও পরিচিত। প্রতারক চক্রের সদস্যরা এমন ড্রাগ ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের মানসিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে। ফলে চক্রের সদস্যদের কথা মতো চলতে থাকে ভুক্তভোগীরা। এ সুযোগেই সর্বস্ব হাতিয়ে নেয় চক্রটি।

সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় এমন প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন অনেকে। এ চক্র এখন রাস্তা ছাড়িয়ে বিভিন্ন বাসাবাড়িতেও ঢুকে প্রতারণা করছে। মধ্য বয়সি জাহেদা খাতুন নামে এক নারীও পড়েন এমন প্রতারণার ফাঁদে। গত আগস্ট মাসে তিনি তেজগাঁও রেলস্টেশন রোডের নিমতলী সামনে দিয়ে কারওয়ানবাজার যাচ্ছিলেন। এ সময় একজন তার গা-ঘেঁষে সামনের দিকে চলে যায়। আরেকজন তার কাছে এসে একটি চিরকুট ধরিয়ে এতে লেখা ঠিকানা জানতে চায়। ছোট অক্ষরে লেখা থাকায় জাহেদা একটু কাছে নিয়ে লেখা বুঝার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে তিনজন তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। এরপর প্রতারকরা তার কাছে থাকা টাকা-মোবাইল চাইলে তিনি সব কিছু দিয়ে দেন।

এ বিষয়ে জাহেদা খাতুন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘একজন লোক আমার গা-ঘেঁষে চলে যাওয়ার পর আরেকজন আমার কাছে একটি ঠিকানা জানতে চায়। তাকে আমি ঠিকানা বলতে বলতে আমার কী যেন হয়ে গেল। তারা আমাকে যা বলছে, আমি তাই করছি। কিছু সময়ের জন্য আমার কোনো বোধ ছিল না।’

এ প্রতারক চক্রটি শুধু রাস্তায় নয়, বাসাবাড়ির বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করে প্রতারণা করছে। তাদের মূল টার্গেট মধ্য বয়সি নারীরা। একটি প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে এমন প্রতারণার করে একটি এক্সিও গাড়ি, ১৫ লাখ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার হাতিয়ে নিয়েছে এক প্রতারক।’

ভুক্তভোগী ওই নারী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘প্রতারক আমার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত। সে আামাকে খাবারের সঙ্গে কিছু একটা খাওয়ায়। তারপর আমাকে তার কন্ট্রোলে নিয়ে নেয়। আমার আর কোনো বোধ-জ্ঞান ছিল না। এভাবে আমার কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও একটি গাড়ি হাতিয়ে নেয়।

জানা যায়, স্কোপোলামিন নামক ওই ওষুধ খাবারের সঙ্গে অথবা শ্বাসের মাধ্যমে মানব দেহে প্রবেশ করে। এতে করে মানুষ তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ফলে দুই বছরের একটি শিশু বাচ্চার মতো আচরণ করে। নিজস্ব কোনো প্রতিক্রিয়া বা জ্ঞান-বুদ্ধি কাজ করে না। আর এ সুযোগে প্রতারকরা সর্বস্ব লুটে নেয়।

সম্প্রতি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এমন এক প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে। স্কোপোলামিন নামক ওষুধ মূলত লিকুয়েড ও শুকনা ধরনের হয়। তাই এটিকে আবার শয়তানের শ্বাস বলা হয়। মূলত এটি ৬ থেকে ১২ ইঞ্চির দূরত্ব থেকে শ্বাসের মাধ্যমে মানব দেহে প্রবেশ করে। যার প্রতিক্রিয়া থাকে প্রায় ১ ঘণ্টা। এ সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগীরা সম্পূর্ণভাবে প্রতারকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আবার স্কোপোলামিন খাবারের সঙ্গেও খাওয়ানো হয়। খাবারের সঙ্গে মানব দেহে গেলে এটির প্রতিক্রিয়া থাকে প্রায় ৫ থেকে ৭ দিন।

র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমাদের কাছের এ ধরনের প্রতারণার অনেক অভিযোগ আসছে। আমরা এরই মধ্যে এক প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছি। অন্য প্রতারকদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এ ধরনের প্রতারণার আদোপান্ত বের করার চেষ্টা চলছে। এখনই এ বিষয় নিয়ে পুরোপুরি বলা যাচ্ছে না। অভিযান অব্যাহত আছে। পরে বিস্তারিত জানানো যাবে।

কীভাবে কাজ করে ‘ডেভিল ব্রেথ’ পার্টি : স্কোপোলামিন মাদক ব্যাবহারের কারণে ছিনতাইকারীদের মতো ছুরি, চাকু বহন করা লাগে না এই পার্টির সদস্যদের। এমনকি পকেটমারদের মতো ধরা পড়া বা গণপিটুনি খাওয়ার ঝুঁকিও থাকে না তাদের। প্রথমে এই পার্টির এক সদস্য তার টার্গেটেড লোকের কাছে গিয়ে একটি কাগজ বা মোবাইলের মেসেজ দেখিয়ে ঠিকানা জানতে চায়। আবার কোনো এক রিকশাওয়ালা সদস্য একটি প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে বলবে- বাবা, এই প্রেসক্রিপশনের ওষুধের নামটা কী? কোথায় পাওয়া যাবে?

মানবিক বোধ থেকে তাদের সাহায্য করতে গিয়েই প্রতারণার ফাঁদে পড়েন সাধারণ মানুষ। মূলত কাগজে মধ্যে থাকে স্কোপোলামিন ওষুধ। তাদের দেওয়া কাগজ, ফোন বা অন্যকিছু নাক ও চোখমুখের কাছাকাছি ধরার সময় শ্বাসের মাধ্যমে স্কোপোলামিন গ্রহণ করে ফেলবেন। মুহূর্তের মধ্যে চিন্তাশক্তি অকার্যকর হয়ে হিপনোটাইজড হওয়া এবং ভিকটিমের সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সা, গহনা, মোবাইলসহ সব কিছু দিয়ে দেন ভয়ঙ্কর ‘ডেভিলস ব্রেথ’ পার্টির সদস্যের হাতে।

র‌্যাব-৪ এর স্পেশাল কোম্পানি কমান্ডার মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, এই পার্টি প্রধানত জুয়েলারি, ব্যাংক, মার্কেটের আশপাশে ঘোরাফেরা করে এবং অর্থওয়ালা পথচারী নারীদের টার্গেট করে। আবার বিভিন্ন বাসার নারীদের টার্গেট করে প্রতারণা করে। স্কোপোলামিন ব্যবহার প্রতারকদের একটি নতুন কৌশল। এটি লিকুয়েড ও পাউডার জাতীয় হয়। টার্গেটকৃতদের খাবারের মাধ্যমে অথবা শ্বাসের মাধ্যমে কিংবা হ্যান্ডশেকের সময় হাতে একটা পিন ফুটিয়ে প্রয়োগ করা হয়। এটা প্রথমে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কের প্রাথমিক স্মৃতি বা ইনিশিয়াল স্টেজ অব মেমোরিকে ব্লক করে দেয়। সেই সঙ্গে ব্রেইনের অংশকে আক্রান্ত করে যা তার মস্তিষ্কের চিন্তা করার অংশকে ব্লক করে দেয়। এর ফলে তার চিন্তা করার ক্ষমতা চলে যায়। কোনো প্রতিক্রিয়া বা বোধশক্তি থাকে না। আচরণ হয়ে যায় বশীভূত! তখন তাকে যে কমান্ড দেওয়া হয়, সে তাই মানে।

কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের রেসিডেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. মো. রাহেনুল ইসলাম বলেন, স্কোপোলামিন মেডিসিন মানব দেহে ব্যবহার বেশ ভয়ঙ্কর বিষয়। নাসা তাদের অ্যাস্ট্রোনাটদের ওপর ০.৩৩ মিলিগ্রাম ইউজ করে, তাদের মোশন সিকনেস কাটানোর জন্য। আর যেকোনো সাধারণ মানুষের ওপর যদি এর ৫-৭ মিলিগ্রাম ইউজ করা হয় তবে সে হয়ে যাবে এমন হেল্প লেস। তাকে দিয়ে যা ইচ্ছা করানো যাবে! আর যদি ১০ মিলিগ্রাম বা তার বেশি হয় তবে রোগী কোমায় চলে যাবে এবং সেখান থেকে মারা যেতে পারে।

পরামর্শ : র‌্যাব-৪ এর স্পেশাল কোম্পানি কমান্ডার মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, রাস্তাঘাট, জুয়েলারি, ব্যাংক, যেকোনো শপিং সেন্টার থেকে বের হওয়ার সময় এই ঘটনাগুলো মনে রাখতে হবে সবাইকে। বাসায় অপরিচিত কেউ এলে কিংবা রিকশায় চলাচলের সময়ও সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া অপরিচিত কেউ বেশি ঘনিষ্ঠ বা পরিচিত আচরণ করলে তার পরিচয় জেনে এবং নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close