জিয়াউদ্দীন রাজু

  ২২ নভেম্বর, ২০২১

আর কী হতে পারে মেয়র জাহাঙ্গীরের!

বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি করায় দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার হয়েছেন গাজীপুর সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। এখন নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হওয়ায় মেয়র পদে থাকতে পারবেন কি না- এ নিয়ে দেশের সর্বত্র আলোচনা চলছে। সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। কারণ স্থানীয় সরকার আইনে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই।

তবে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কারের মাধ্যমে সারা দেশের তৃণমূলে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে- দাবি করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তারা বলছেন, দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কোনোমতে ছাড় দেওয়া হবে না। যার যত কাছের মানুষ, যার যত প্রিয় মানুষ হোক না কেন, সেটা দেখার বিষয় নয়। তিনি যেহেতু বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করেছেন, তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হওয়ায় তিনি মেয়র পদে নাও থাকতে পারেন।

জাহাঙ্গীরের বহিষ্কারের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘দল তাকে বহিষ্কার করেছে। এখানে স্থানীয় সরকার আইনে বিশ্লেষণ করে তারা ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ায় বিধিবিধান অনুযায়ী নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি ক্ষমতাসীন দল তার বিরুদ্ধে মামলা করে এবং সে মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়, যদি তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ কাউন্সিলরের সমর্থন হারান এবং তারা যদি অনাস্থা আনেন, তাহলে জাহাঙ্গীরের মেয়র পদে থাকা অনিশ্চিত হয়ে যাবে। তবে আইনি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার আইনে এমন কিছু বিধান আছে, যে কারণে জাহাঙ্গীরের মেয়র পদ ঝুঁকিতে পড়ে যাবে বলে মনে করছেন অনেকে।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এ বিষয়ে সাংবাদিদের বলেন, ‘মেয়র পদে থাকবে কি না- এ বিষয়টা আইন পর্যবেক্ষণ না করে আমার পক্ষে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। আইন দেখে পরবর্তীতে এ ব্যাপারে মন্তব্য করা হবে। এখন মেয়র আছে। কত দিন থাকবে, সেটা আইন দ্বারা নিষ্পত্তি করা হবে।’ গত শনিবার ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে ড্যাপ নিয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করলে এসব কথা বলেন তিনি।

জাহাঙ্গীর আলম মেয়র পদে থাকবেন কি না ও স্থানীয় সরকারের পদক্ষেপ কী হবে- এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। দলীয়ভাবে বহিষ্কার করলে এখন কী হবে, তা আইনগত বিষয়।’

সচিব বলেন, ‘ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে আদালতে চার্জশিট দাখিল করলে এ ক্ষেত্রে আমরা আইনগতভাবে ব্যবস্থা নিই। বিষয়টি তলিয়ে দেখে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।’

নির্বাচন কমিশনের সাবেক এই সচিব আরো বলেন, ‘উনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। দল থেকে বহিষ্কার করেছে, তিনি তো দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত। এটা আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা। এর আইনগত দিক আলাপ-আলোচনা করে কাজ করতে হবে।’

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনে ‘মেয়র ও কাউন্সিলরদের সাময়িক বরখাস্তকরণ’ অংশে বলা হয়েছে- ‘মেয়র অথবা কাউন্সিলর পদ থেকে অপসারণযোগ্য হবেন, যদি তিনি- (ক) যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া সিটি করপোরেশনের পর পর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকেন অথবা (খ) নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হন; (গ) দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করেন অথবা শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন; (ঘ) অসদাচরণ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন; (ঙ) নির্বাচনের অযোগ্য ছিলেন মর্মে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিন মাসের মধ্যে প্রমাণিত হয়; (চ) বার্ষিক ১২টি মাসিক সভার পরিবর্তে ন্যূনতম নয়টি সভা গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া অনুষ্ঠান করতে বা ক্ষেত্রমতো সভায় উপস্থিত থাকতে ব্যর্থ হন। এখানে ‘অসদাচরণ’ বলতে ক্ষমতার অপব্যবহার, এ আইন অনুযায়ী বিধিনিষেধ পরিপন্থি কার্যকলাপ, দুর্নীতি, অসদুপায়ে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণ, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি, ইচ্ছাকৃত অপশাসন, নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দাখিল না করা বা অসত্য দেওয়াকে বোঝাবে।

আইনে আরো বলা আছে, অপসারণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে বিধি অনুযায়ী তদন্ত ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। সিটি করপোরেশনের কোনো মেয়র বা কাউন্সিলরকে পদ থেকে অপসারণ করা হলে, ওই আদেশের তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল করতে পারবেন এবং আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অপসারণের আদেশ স্থগিত থাকবে। সব পক্ষকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিতে রাষ্ট্রপতি ওই অপসারণের আদেশ পরিবর্তন, বাতিল বা বহাল রাখতে পারবেন।

আপিলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির আদেশই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। অপসারিত কোনো ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের কার্যকালের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হবেন না। তবে দল থেকে বহিষ্কার হলে কী করা হবে, সে বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই।

আইনের এই অস্পষ্টতা একটি ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন আইনে দল থেকে বহিষ্কার হলে কী হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান নেই। আইনত তার পদ ছেড়ে দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে ফয়সালা হতে পারে।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত কোনো সিটি মেয়রের দল থেকে বহিষ্কারের ঘটনা দেশে এই প্রথম জানিয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্থানীয় সরকারের এমন কোনো আইন নেই যে, তাকে মেয়র পদ হারাতে হবে। জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রে এটা করা হয়। তবে স্থানীয় সরকার আইনের নানা ফাঁকেও জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কারের সুযোগ আছে। যেমন নির্বাহী আদেশে মন্ত্রণালয় থেকে মেয়রের পদ বহিষ্কার করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে নৈতিক স্থলন বা ফৌজদারি অপরাধ থাকতে হবে।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের নিয়ে একটি মন্তব্যের অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গত ১৯ নভেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close