হাসান ইমন
বাস্তবায়নের পথে ড্যাপ
কিছুটা কাটছাঁট করে বাস্তবায়নের পথে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)। এরই মধ্যে নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থাপত্যবিদ, রিহ্যাব, সিটি করপোরেশন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সব শ্রেণি-পেশার সঙ্গে বসে নতুন ড্যাপে সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। নতুন কিছু চমকপ্রদ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাজধানীকে যানজট মুক্ত করতে তিনটি রিং রোড, বাস রুট র্যাশনালাইজেশন, মেট্রোরেল ও খাল সচল করে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা। পুরান ঢাকাসহ বাসযোগ্য শহর গড়তে নতুন ড্যাপে নানা প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় কর্মশালার পর গেজেটভুক্ত হবে নতুন ড্যাপ।
রাজধানী ঢাকা ঘিরে তৈরি ২০ বছর মেয়াদি এই উদ্যোগের অনুমোদন পেতে যাচ্ছে শিগগির। এটা বাস্তবায়নে ছিল নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা। এবার সেই সব প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা পেছনে ফেলে আগামী দুই মাসের মধ্যেই ড্যাপের গেজেট প্রকাশের কথা জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। গত ২৪ অক্টোবর এক সভায় তিনি বলেন, ‘ড্যাপ চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থাপত্যবিদ, রিহ্যাব, বিএলডিএসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার এবং ড্যাপ-সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সভা করে তাদের মতামত ও পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই ড্যাপ চূড়ান্ত করে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।’
মন্ত্রী আরো বলেন, ‘ভূমির সঠিক ব্যবহার করে আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকাসহ কৃষি অঞ্চল, জলাশয়, ওয়াটার রিটেনশন, বনাঞ্চল, উন্মুক্ত স্থান, বন্যাপ্রবাহ এলাকাসহ সবকিছুই পরিকল্পনায় নিয়ে এটি প্রণয়ন করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে ড্যাপ প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আগের ড্যাপে নতুন করে অনেক কিছু সংযোজন করা হয়েছে। এরমধ্যে পুরান ঢাকার রি-জেনারেশন পরিকল্পনা, খাল উদ্ধার ও নদীপথ সচল, ব্লক ভিত্তিক উন্নয়ন, স্টেশন ভিত্তিক উন্নয়ন, এলাকা ভিত্তিক ফ্লোর এরিয়া অনুপাতসহ অনেক কিছু।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘ড্যাপ নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন স্টোকহোল্ডার ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে। মোটামুটি খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। শুনেছি আগামী মাসে জাতীয় কর্মশালা হবে। ওই কর্মশালায় জানা যাবে খসড়া ড্যাপে কী কী পরিবর্তন এসেছে। ওই পরিবর্তনের আলোকে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আমরাও (বিআইপি) একটা প্রস্তাব দেব। ড্যাপ-সংশ্লিষ্টরা যৌক্তিক মনে করলে সংযোজন-বিয়োজন হবে। এরপর গেজেট আকারে প্রকাশ হবে।’
বেঁধে দেওয়া ভবনের উচ্চতা থেকে সরে আসা এক ধরনের বোকামি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে আনতে ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়াটাই ঠিক। ঢাকা শহরে নগরায়ণের সঙ্গে কিন্তু তাপমাত্রাও বেড়েছে। জনসংখ্যা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে না আনলে বাসযোগ্যতা হারানোর শঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে ভবনের উচ্চতা বেঁধে ব্যবস্থা না দিলে মানুষ আগের মতোই ভবন নির্মাণ করবে। এর জন্য আবাসিক এলাকায় ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়াটাই ঠিক ছিল।’
এই নগর পরিকল্পনাবিধ বলেন, ‘নতুন ড্যাপে যানজট নিরসনে যে পরিকল্পনা নিয়েছে, সেটা সময়োপযোগী পদক্ষেপ। ঢাকাকে সচল করার জন্য ভালো উদ্যোগ। ঢাকার চারপাশে চার নদী ও অসংখ্যা খাল রয়েছে। এগুলোকে সচল করার প্রস্তাব রয়েছে এ ড্যাপে। তবে বিচ্ছিন্ন পরিকল্পনা না করে সমন্বিত পরিকল্পনা (ইন্টিগ্রেটেড প্ল্যান) করে এগোতে হবে। তাহলে বাসযোগ্য শহর গড়ে উঠবে।’
নতুন ড্যাপে যা থাকছে : নতুন ড্যাপ ২০ বছরের জন্য তৈরি করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা ধরে মোট ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার ভূমি নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে ঢাকাকে একটি বাসযোগ্য ও দৃষ্টিনন্দন শহর হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। যার মূল লক্ষ্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রয়োজন ও জীবনযাত্রাকে উন্নত করা। জনঘনত্ব বিন্যাস পরিকল্পনার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত মিশ্র ভূমি ব্যবহারে উৎসাহ, নৌপথের সমন্বয়ে ব্লু নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা এবং অবকাঠামোর সার্বিক রূপান্তর করে নগরজীবন প্রতিষ্ঠা করা-এই বিষয়গুলো সামনে রেখে পাঁচটি ধাপ অনুসরণে তৈরি করা হয়েছে ড্যাপ।
প্রস্তাবিত ড্যাপে রাজউকের আওতায় মোট ১ হাজার ৫৮২ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ৪৬৮টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ্যে থাকবে ১৯৮ কিলোমিটার জলাধার। সিএস রেকর্ড অনুযায়ী, সেগুলো উদ্ধার করে সচলের সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকার চারপাশের ৫৬৬ কিলোমিটার নদীপথ সচল, ১ হাজার ২৩৩ কিলোমিটার সড়ককে হাঁটার উপযোগী করে তোলা, শহরের বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে স্কুল ভিত্তিক উন্নয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এর বাইরে ঢাকায় সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে সড়ক, জল ও রেলপথকে গুরুত্ব দিয়ে একটি সমন্বিত যোগাযোগমাধ্যম গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্লক ভিত্তিক উন্নয়ন, আবাসিক-বাণিজ্যিক ও শিল্প ভবন (মিশ্র ব্যবহার), পার্কিং না রেখেও হবে বহুতল আবাসিক ভবন, রাস্তার প্রশস্ততা হবে সর্বনিম্ন ৬ ফুট, বন্যাপ্রবাহ এলাকায় চলাচলের জন্য এক্সপ্রেসওয়ে, কালভার্ট-বক্স কালভার্ট তুলে নৌপথ, প্রতি ওয়ার্ডে স্কুল ও হাসপাতাল, উন্মুক্ত স্থানের নিচে জলাধার করার সুপারিশ করা হয়েছে।
ভবনের উচ্চতা নির্দিষ্টই থাকছে। প্রস্তাবিত ড্যাপে মিরপুরে চার-সাততলা, মোহাম্মদপুর ও লালমাটিয়ায় পাঁচ-আটতলা, খিলখেত, কুড়িল, নিকুঞ্জ এলাকায় ছয়তলা, উত্তরায় সাত-আটতলা, গুলশান, বনানী ও বারিধারায় ছয়-আটতলা আবাসিক ভবনের সর্বোচ্চ উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর জনঘনত্ব কমাতে ফ্লোর এলাকার অনুপাত নির্ধারণের পরিকল্পনা থাকছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে রাজধানীতে জনঘনত্ব কমবে।
"