নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৭ অক্টোবর, ২০২১

সমবায়ের নামে শতকোটি টাকা আত্মসাৎ, আটক ১০

গ্রাহকের টাকায় জসিমের সম্পদের পাহাড়

সমবায়ভিত্তিক কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। গত সোমবার দুপুর থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে তাদের আটক করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-৪ (র‌্যাব)। এর আগে সোমবার সকাল থেকে দুই শতাধিক গ্রাহক পল্লবীতে প্রতিষ্ঠানটির সামনে বিক্ষোভ করেন।

র‌্যাব জানায়, সমবায়ভিত্তিক দারিদ্র্য নিরসনের দায়িত্বে নিয়োজিত সমবায় অধিদপ্তরের অনুমোদন ছিল কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির। ২০১৯-২০ সালে সমবায় অধিদপ্তর অডিটও করে। এতে দেখানো হয়, ৫১৮ জন সদস্যের লেনদেন হয় ৮২ লাখ টাকা। তবে র‌্যাবের তদন্ত বলছে, প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ হাজার। আর দেলদেন হয়েছে ১০০ কোটি টাকার অধিক। এসব টাকা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার জসিম উদ্দিনের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে মানিলন্ডারিং করা হয়েছে। অর্থ আত্মসাৎ করে গড়েছেন নামে-বেনামে প্লট-ফ্ল্যাট ও জমি। ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ আটটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।

র‌্যাবের দাবি, সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধনভুক্ত হলেও প্রতিষ্ঠানটির সব ধরনের কার্যক্রম প্রতারণামূলক। নিয়ম অনুযায়ী, সমিতি পরিচালনার অনুমোদন থাকলেও আর্থিক লেনদেনের অনুমোদন নেই। এছাড়া এনজিও এবং মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরির আর্থিক লেনদেনের অনুমোদনও নেই।

ভুক্তভোগীদের এমন নানা অভিযোগে র‌্যাব-৪ সোমবার দুপুর থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত মিরপুর ১১/এ, রোড নং-৬, প্লট-৪, নান্নু সুপার মার্কেটে অভিযান চালিয়ে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক শাকিল আহম্মেদসহ ১০ জনকে আটক করে। তবে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার পলাতক রয়েছে। আটক অন্যরা হলেন মো. চাঁন মিয়া, এ কে আজাদ, মো. রেজাউল, তাজুল ইসলাম, শাহাবুদ্দিন খাঁন, আবদুস ছাত্তার, মাসুম বিল্লা, টিটু মিয়া ও আতিকুর রহমান।

অভিযানের সময় প্রতারণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে ১৭টি মুদারাবা সঞ্চয়ী হিসাব বই, ২৬টি চেক বই, ২টি ডিপোজিট বই, ৩টি সিল, ১২০টি ডিপিএস বই, একটি রেজিস্টার বই, একটি নোটবুক, একটি সেলারি শিট, ৩০টি জীবন-বৃত্তান্ত, ৫টি ক্যালেন্ডার, ৮ পাতা ডিপিএসের মাসিক হিসাব বিবরণী, ৩টি পাসপোর্ট, একটি ডিভিআর মেশিন, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ কপি ২৮ পাতা, একটি ব্যানার এবং নগদ ৪ লাখ ২২ হাজার ৮০ টাকা জব্দ করা হয়।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, মূল অভিযুক্ত জসিম নিজেই সমিতির সভাপতি, সহসভাপতি তার শ্বশুর মোতালেব সরকার, সাধারণ সম্পাদক তার প্রথম স্ত্রী লাকী আক্তার এবং কোষাধ্যক্ষ তার শ্যালিকা শাহেলা নাজনীন। এমনকি যুগ্ম সম্পাদকও তার নিকট আত্মীয় লাভলী আক্তার। এটি এক রকম পারিবারিক সমিতি। প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধনপ্রাপ্ত।

সরকারি হিসাবে প্রতিষ্ঠানটিতে ৫১৮ জনের কথা উল্লেখ করা হলেও গ্রাহকদের অভিযোগ ও র‌্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে প্রতিষ্ঠানটিতে অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার গ্রাহক রয়েছে। তারা শতকোটির বেশি টাকা লেনদেন করেছেন।

আটক শাকিল আহম্মেদ ও চাঁন মিয়া ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা প্রদানের নিশ্চয়তা দিয়ে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে বিনিয়োগ বা ডিপিএস করতে আগ্রহী করতেন। এভাবে প্রলুব্ধ হয়ে বস্তি এলাকার গার্মেন্টকর্মী, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, অটোচালক, সবজি ব্যবসায়ী, ফল ব্যবসায়ী, গৃহকর্মী ও নি¤œআয়ের মানুষরা বিনিয়োগ করতেন। প্রতি সদস্য মাসিক ১০০ থেকে ১ হাজার টাকা করে কথিত ডিপিএস জমা করতেন। তিন বছরে ৩০ শতাংশ এবং পাঁচ বছরে ৫০ শতাশং মুনাফা প্রদানের শর্তে এই টাকা গ্রহণ করা হতো।

তবে ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনুযায়ী, তাদের নিয়মিত লভ্যাংশ দেওয়া হতো না। ডিপিএসের মেয়াদ পূর্ণ হলেও পাওনা টাকা পরিশোধ করা হতো না। অধিক মুনাফার লোভে করোনার সময়েও ভুক্তভোগীরা সঠিক সময়ে ডিপিএসের টাকা জমা দিলেও লভ্যাংশ পায়নি। ভুক্তভোগীরা লাভের টাকা চাইতে গেলে হুমকি-ধমকি প্রদর্শন করা হতো। নারী গ্রাহকদের প্রতি অশালীন মন্তব্য, পুরুষ সদস্যদের টর্চার সেলে নিয়ে মারধর করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযান পরিচালনার সময় শাকিলের অফিসের টর্চার সেল থেকে মারধরের সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।

মোজাম্মেল হক বলেন, কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড ছাড়াও জসিম নিজের নামে-বেনামে আরো সাতটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। জসিম মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কর্ণফুলী রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, জসিম ইন্টারন্যাশনাল ওভারসিস লিমিটেড, জসিম স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি ফার্ম, জসিম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, জসিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, জসিম নিট কম্পোজিট লিমিটেড। এসব কোম্পানির নামে লেনদেন ও টাকা স্থানান্তর করলেও কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস ছাড়া বাকি সাত কোম্পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

র‌্যাব-৪ অধিনায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, জসিমের আয়ের মূল উৎস কর্ণফুলী মাল্টিপারপাসে ভুক্তভোগীদের ডিপিএস বা এফডিআরের টাকা। অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির জসিম সমিতির অফিসে আসতেন না। সমিতির ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা উত্তোলন করে অন্যত্র স্থানান্তর করতেন। গ্রাহকের টাকায় তিনি বসুন্ধরায় ফ্ল্যাট, গ্রিন রোডে ফ্ল্যাট, গাজীপুরের মাওনায় রয়েছে আরো দুটি প্লট ও তিনতলা ফ্ল্যাট বাড়ি, মিরপুরে বাড়ি, কাউনিয়া মৌজা ও গাজীপুরে বেশ কয়েক একর জমি ক্রয় করেছেন।

র‌্যাব জানায়, মূল অভিযুক্ত পলাতক আসামি জসিম উদ্দিন মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেন। একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে রিপ্রেজেন্টিটিভ হিসেবে কাজ করলেও ২০০৩ সালে তিনি অল্প সময়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন।

জসিমসহ তার পারিবারের বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তার সম্পর্কে মোজাম্মেল হক বলেন, র‌্যাবের তথ্য মতে জসিম দেশেই আছে। তাকেসহ পারিবারিক চক্রটির সদস্যদের আটকের চেষ্টা চলছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close