আরমন ভূঁইয়া

  ২৭ অক্টোবর, ২০২১

ফুটপাত হকারদের আতঙ্ক চাঁদাবাজ

রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বরে ১৫টি মার্কেটের সামনে ফুটপাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিন ৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছে সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ চক্র। এই চক্রের পেছনে রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ। দীর্ঘদিন ধরে হকারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করলেও প্রশাসনের নেই কোনো ভূমিকা। আর এসব সিন্ডিকেটের মূলে কবির বাহিনী।

ফুটপাতের হকারদের অভিযোগ, দোকান বসলেই দিতে হয় চাঁদা। প্রতিদিন প্রত্যেক হকার থেকে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা চাঁদা আদায় করছে চাঁদাবাজরা। তিন হাজারের অধিক হকার থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। কোনো হকার চাঁদা দিতে রাজি না হলে কবিরের সন্ত্রাস বাহিনী দিয়ে হামলা ও ভয়ভীতি দেখানো হয়। অনেক সময় পুলিশি হয়রানির অভিযোগও রয়েছে। ফুটপাতের এসব দোকানে বিদ্যুৎও সরবরাহ করে কবির। হকারদের লাইটপ্রতি ৩০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।

সরেজমিন হকার, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় প্রায় ১৫টি মার্কেটের সামনের ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় করছে সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজরা। প্রত্যেক মার্কেটের সামনের ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করে একেক চাঁদাবাজ। এর মধ্যে ৭টি মার্কেটের সামনের ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় করে কবির বাহিনীর লোকজন। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশকে ম্যানেজ করে ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করে কবির বাহিনী। শুধু তাই নয়, নতুন করে কোনো হকার দোকান বসাতে চাইলে জায়গা বাবদ এককালীন গুনতে হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। চাঁদার টাকা তিন ভাগ হয়ে যায় পুলিশ, স্থানীয় নেতা ও চাঁদাবাজদের পকেটে। প্রতি মাসে প্রায় দেড় কোটি টাকার অধিক চাঁদা আদায় করা হয় হকারদের থেকে। যা বছরে দাঁড়ায় ১৮ কোটি টাকা।

জানা যায়, মিরপুর-১ নম্বর মুক্তযোদ্ধা মার্কেট, ফেরার প্লাজা, ছিন্নমূল মার্কেট, বাগদাদ মার্কেট, মা প্লাজা, মুক্তবাংলা ও নিউমার্কেটের সামনের ফুটপাত এককভাবে নিয়ন্ত্রেণ করে কবির। তার প্রধান সহযোগী হাবিব, রাজিব, সোহেল, মনির, মিজান, এনামুল, জীবনসহ অনেকে। মূলত তার বাহিনী দিয়েই এসব এলাকার ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় করা হয়।

হকাররা জানান, কবিরের নির্দেশে একেক সময় একেকজনকে দিয়ে চাঁদা তোলা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হকার বলেন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় কবিরের লোকজন এসে চাঁদা আদায় করেন। চাঁদা দিতে দেরি হলে মারধর করা হয় তাদের। আবার পুলিশ দিয়েও হয়রানি করার অভিযোগ করেন তারা। আরেক হকার আহাদ আলী (ছদ্মনাম) বলেন, এখানকার হকাররা সবসময়ই চাঁদাবাজদের ভয়ে থাকেন। তাদের কথার সামান্য বিরোধিতা করলে দোকান তুলে দেয় কবির বাহিনীর লোকজন। স্থানীয় নেতারা কবিরের চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।

অন্যদিকে, শাহ্ আলী মার্কেট এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে হান্নান। শাহ্ আলী কলেজ মার্কেট এলাকার কাঁচাবাজার নিয়ন্ত্রণ করেন সুরুজ, মিলন ও চাটগাইয়া হারুন। সিটি করপোরেশন মার্কেট (ডিসিসি) এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে নয়ন, হান্নান ও রুবেল। কো-অপারেটিভ মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করে হান্নান, মুক্তি প্লাজা নুরু, হক প্লাজা কিরণ, ক্যাপিটাল প্লাজা আকবর, বাসস্ট্যান্ড এলাকায় (পূর্ব পাশ, প্রিন্সবাজার এলাকা) হাবিব এবং ভাস্যমান হকারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে রতন।

শাহ্ আলী মার্কেটের পূর্ব পাশের এক হকার বলেন, এখানকার ফুটপাতের হকার থেকে চাঁদা আদায় করে হান্নান কাকা। প্রতিদিন ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।

এ ব্যাপারে মুঠোফোনে জানতে চাইলে হান্নান বলেন, ‘ফোনে এ ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না। আমি চাঁদা তুলি এমন কোনো প্রমাণ নেই।’ ক্যাপিটাল মার্কেট এলাকায় চাঁদাবাজি সম্পর্কে জানতে চাইলে আকবর বলেন, ‘আমি এসব কিছু জানি না। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া আছে। এর চেয়ে বেশি বলা যাবে না।’

মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের সামনের এক হকার বলেন, এই পুরো এলাকার হকারদের কাছ থেকে চাঁদা নেন কবির। তিনিই পুরো ১ নম্বর ফুটপাত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলার মতো কেউ নেই।

কো-অপারেটিভ মার্কেট এলাকা নিয়ন্ত্রণকারী মো. খলিল বলেন, ‘আমি চাঁদা নেই না। এখানকার ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলেন কবির ও তার লোকজন। এই মার্কেটের সামনে আমার একটা দোকান আছে। আমি স্থানীয় রাজনীতি করি। এখানকার কিছু হকার আমার সঙ্গে মিছিল-মিটিংয়ে যায়। আমার সঙ্গে হকারদের কোনো লেনদেন নেই।’

ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির সম্পর্কে জানতে চাইলে কবির বলেন, ‘এখানে ফুটপাত আমরা বসাই না। এটা দলীয় মাধ্যমে বসে আর টাকা তাদের লোকজন খায়। কোনো জায়গায় দলীয় ছাড়া কিছু হয় না। দলীয় নেতারা একেক সাইড দেখভাল করে। এই যেমন প্রপার্টি মার্কেট চালায় মার্কেট কমিটি। মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট চালায় ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য। শাহ্ আলী মার্কেট হান্নান, সিটি করপোরেশন মার্কেট নয়ন, হক মার্কেট হকের ছেলে কিরণ, এদিকটা মোল্লা নাবিল খান। আমাদের কাজ হলো আমরা ফুটপাত নিয়া ঘাঁটি। সবকিছু ম্যানেজ করি।’

বিদ্যুতের লাইন নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে কবির বলেন, ‘কাঁচাবাজার এলাকায় বিদ্যুতের লাইন নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল ও জালাল। আমি মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত হকারদের বিদ্যুৎলাইন দেখভাল করি।’

হকার্স লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এম এ কাশেম বলেন, ‘আমরা ফুটপাতের চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। পুলিশের কাছে একাধিকবার আবেদন করেছি। তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। বরং অনেক জায়গা থেকে আমাদের নানা রকম হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়েছে।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) উপকমিশনার (ডিসি) আ ম স মাহতাব উদ্দিন বলেন, ‘হকাররা চাঁদা দেয় কেন! চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব সময় তৎপর। কোনো হকার কাউকে চাঁদা দেবে না-দেখি কী করে চাঁদা আদায় করে। হকারদের কাছে কেউ চাঁদা চাইতে এলে অথবা কোনো রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন করলে থানায় এসে পুলিশকে জানান অথবা সরাসরি ডিসি অফিসে যোগাযোগ করুক।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close