গাজী শাহনেওয়াজ

  ২৪ অক্টোবর, ২০২১

তথ্য বিভ্রান্তে বিব্রত ইসি

ছবিসহ ভোটার জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়নের পরও বিপত্তি পিছু ছাড়ছে না নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। ডিজিটাল প্রযুক্তি চালুর একযুগ পরেও ভোটার পরিচয়পত্রে নানা অসঙ্গতি দূর করতে পারেনি কমিশন। কারণ হরেক রকমের বিভ্রান্তি রয়েছে ভোটারের তথ্যে। এসব অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্যের কারণে বিব্রত ইসি, ভোটারদের পড়তে হচ্ছে নানা অসুবিধায়।

ম্যানুয়ালী ভোটার তালিকায় ভুয়া ভোটার তালিকার্ভুক্ত করার কারণে ২০০৬ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল হয়, পরবর্তন হয় এম এ আজিজ কমিশন। ওই সময়ে অভিযোগ ছিল, ভোটার তালিকায় ১ কোটি ২০ লাখ ভুয়া ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ছবিসহ জাতীয় ভোটার পরিচয়পত্র প্রনয়নের উদ্যোগ নেয় পুনগর্ঠিত এটিএম শামসুল হুদা কমিশন। মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে ৯ কোটি ভোটারকে তালিকার্ভুক্ত করে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ভোটার হওয়ার পর জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়ে ব্যাংক একাউন্ট খোলাসহ নানা সেবা নেন অনিতা বড়ুয়া নামে নামে একজন ব্যক্তি। কিন্তু অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে জানতে পারেন, - তিনি ভোটার হলেও তথ্যে গড়মিল। আইডির নং দিয়ে তথ্য খুঁজতে গিয়ে সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষ দেখতে পান ‘ম্যাচ ফাউন্ড’ লেখা। আবার ফাতেমা আক্তার নিজের তথ্য দিয়ে ভোটার হলেও প্রয়োজনীয় সেবার জন্য আবেদন করতে গিয়ে দেখতে পান অন্যের ব্যক্তিগত তথ্য তার সার্ভারে ‘শো’ করছে। একই ভাবে মো. হাবিবুর রহমানের ছবি বদলে অপরিচিতি অন্য একজন নাগরিকের ছবি দেখাচ্ছে তার ভোটার সার্ভারে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে সংশ্লিস্ট ভোটার আইডিতে হরেক রকমের তথ্যের অসঙ্গতির কারণে লজ্জায় পড়ে যেতে হচ্ছে তাকে। কেউ কেউ নানাভাবে হচ্ছেন বিব্রত।

জানা গেছে, নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) টিকা নিতে সুরক্ষা অ্যাপে সুনিদিষ্ট তথ্যের আলোকে টিকা প্রাপ্তির যোগ্য নাগরিকরা আবেদন করেন। কিন্তু নিবন্ধন করতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়তে হয় অনেক ভোটারকে। দীর্ঘদিন জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়ে সেটা বহুমুখী ব্যবহারে কাজে না লাগানোয় সেখানে অসঙ্গতি ছিল এতোদিন জানতে পারেননি অনেক ভোটারই। প্রথমে জানতে পারেন টিকার নিবন্ধন করতে গিয়ে। শুধু টিকা নয়; নানা ধরণের সেবামূলক সার্ভিস নিতে গিয়ে ভোটার তালিকার স্ট্যাটাসে শো-করছে কারো ‘ম্যাচ ফাউন্ড’ কারো এনআইডিতে ‘ডিলিট’ । এছাড়া জীবিত ব্যক্তি হয়েও ভোটার তালিকায় তাকে মৃত দেখানো এবং স্ট্যাটাসে কারো ‘পাগল’ও দেখা গেছে। এসব ত্রুটির কারণে যথাসময়ে টিকার নিবন্ধন করতে পারেননি শতাধিক মানুষ। এনআইডিতে থাকা ত্রুটি সংশোধনের জন্য আবেদন করছেন ইসিতে। আবেদনের তালিকায় রয়েছেন এখন পর্যন্ত কয়েকশ মানুষ।

এসব অসঙ্গতির কারণে নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিস্টরা স্বস্তিতে নেই। তারা বলছেন, ভোটার নিবন্ধনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের কারণে নাগরিকের তথ্যে এই গড়মিল ও অসঙ্গতি দেখা যাচেছ। কারণ দুই ধাপে ভোটার তালিকার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রথমে ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ এবং তা লিপিবদ্ধ করা এবং দ্বিতীয় ধাপে চোখের আইরিশ, ফিঙ্গারসহ ছবিতুলে আগের তথ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে জাতীয় ভোটার তথ্যভান্ডারে আপলোড করা। এই আপলোডের সময় তথ্যে গড়মিল হয়েছে বলে এনআইডির প্রযুক্তিবিদরা জানিয়েছেন। তারা আরও বলেন, এসব অসঙ্গতি সংশোধনের জন্য আবেদন করলে তা যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই শেষে সংশোধন করে দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, আর যেসব নাগরিকের সার্ভারের ডাটাবেইসে ‘ডিলিট’ লেখা শো করছে এটির মূল কারণ দুইবার ভোটার হওয়া। এ সমস্যাও সমাধান করে দিচ্ছেন তারা বলে জানায়। তবে, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, দায়িত্বে অবহেলা ও অযোগ্যদের দিয়ে দায়সারাভাবে ভোটার তালিকার কাজ করানোর কারণে নাগরিকের ভোগান্ত্রি বেড়েছে। এর দায় ইসির এড়ানোর সুযোগ নেই।

তালিকা পর্যালোচনায় গেছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও খুলনা সব অঞ্চলের মানুষের ভোটার তালিকায় ‘তথ্যের গড়মিল’ রেখে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ভোটার তালিকা থেকে ‘তথ্যের অসঙ্গতি’ সংক্রান্ত স্ট্যাটাস সরাতে এখন পর্যন্ত করা কয়েকশ ব্যক্তি আবেদন করেছেন। নির্বাচন কমিশন এসব আবেদনগুলো যাচাই করছে।

ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা নাহিদা আফরিন। যার এনআইডি নং১৯৮০২৬৯১৬১০০০০৫। নাহিদার ভোটার সার্ভারে লেখা ম্যাচ ফাউন্ড অর্থাৎ অন্যের তথ্য তার এনআইডিতে সংযোজিত আছে। এ নিয়ে বিব্রত সংশ্লিষ্ট ভোটার। আবার ছবি একজনের ভোটার অন্যজন এমন ঘটনাও রয়েছে ভোটার তালিকায়। এমনিই একজন মো. শহীদুল বারী। যার নং-১৯৭৮২৯১০৪১৩৯৭৪২৫৬। তিনি শুধু একা নন, গুলশান এলাকার হ্নদয় হোসেন ও ফাতেমা বেগম, সাবিনা বেগম ও রোজিনা আক্তার, মৌমিতা নীগার মৌনী এবং লালবাগের পাতেমা আক্তার।

মানিকগঞ্জের সিংগাইর এ ধরণের সমস্যা পাওয়া গেছে ১৬জন ব্যক্তির ক্ষেত্রে।

আবার পিরোজপুরের মঠবাড়ীয়া, সদর, ভান্ডারিয়া ও নাজিরপুরে ছয়জন ভোটার রয়েছেন দ্বৈত ভোটারের তালিকায়। এসব ভোটারের স্ট্যাটাসে নির্দেশ করছে, -‘ডিলিট’। এরা হলেন মোক্তার, মনিরুজ্জামান, রোকসানা, সুচিত্রা ও হাফসা আক্তার।

রাজশাহী আঞ্চলের আত্রাই, পল্লীতলা ও নিয়ামতপুরে যথাক্রমে মো. হাবিবুর রহমান, মাজেদা বেগম, শাফায়েত বারী, লিপা রানী সাহা, আবু সালেহ মো মুসা, মমিনুর আক্তার, মানসুরা খাতুন, শাহীনা, বিরেশ, রহিচ উদ্দীন, বাবু, বাসন্তী, পান্না, রাকিব, রউফ ও আল আমিন প্রমুখ। ময়মনসিংহ অঞ্চলের ময়মনসিংহ সদর, মুক্তাগাছা ও হালুয়াঘাটে যথাক্রমে আল আমিন, সোহানুর, জান্নাতুল, তৃষা আক্তার ও গিয়াস উদ্দিন প্রমুখ।

নেত্রকোনার বারহাট্টা ও সদরে লংৎফর রহমান, সজীব চন্দ্র, শেখ সুমন হোসেন, জুলেয়া, বিধা ও মনজুরা খাতুন প্রমুখ। চট্ট্রগামের ও কক্সবাজারের আবদুল কুদ্দুস, শাহ জাহান, রাবেয়া বেপারী, হোছনে আরা বেগম ও জন্নাত প্রমুখ।

জানতে চাইলে এনআইডির মহাপরিচালক কে এম হুমায়ুন কবীর প্রতিদিনের সংবাদকে সম্প্রতি বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রে নানা ধরণের অসঙ্গতি রয়েছে বলে তাদের আবেদন যাচাই করতে গিয়ে দেখতে পারছি। আমরা সবগুলো আবেদন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি। যত দ্রুত সম্ভব এসব আবেদন নিষ্পত্তি করা যায়, -সে চেষ্টা করা হচ্ছে। কমিশন এসব নাগরিকের বিষয়ে খুবই আন্তরিক।

এনআইডির সিষ্টেম ম্যানেজার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, জাতীয় ভোটার পরিচয়পত্রে নাগরিকের তথ্যের যে গড়মিলের কথা বলছেন -এটা ইসির ইচ্ছাকৃত কোনো ভুল না। মাঠ পর্যায়ে যখন একজন নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করে ডাটা এন্ট্রি অপারেটররা ভোটার ফরম পূরণ করে তথ্য সংরক্ষণ করেন এবং দ্বিতীয় ধাপে ওই ব্যক্তির বায়োমেট্টিকসহ ছবিতুলে অন্যান্য দুটি তথ্য একত্রিত করে মূল সার্ভারে আপলোড করতে যান, ওই সময়ে গড়মিল তৈরি হয়ে যায়। দেখা যায়, একজনের তথ্য অন্যজনের তথ্যে এবং ছবিও আরেকজনের সঙ্গে চলে গেছে। এ ধরণের নানা অসঙ্গতি সংক্রান্ত জাতীয় পরিচয়পত্রধারীর আবেদন করলে তথ্য যাচাই করে সংশোধান করে দেয়া হচ্ছে।

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, নাগরিকের তথ্যের অসঙ্গতির দায় ইসি এড়াতে পারে না। তারা দক্ষ কর্মী দিয়ে ভোটার তালিকার কাজ সম্পন্ন করলে এ ধরণের ভুল হওয়ার কথা ছিল না। নির্বাচনসহ সর্বত্রে অস্বচ্ছতার কারণে এই অসঙ্গতির ঘটনা ঘটছে। কারণ স্বচ্ছতা নেই বর্তমান কমিশনের।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close