হাসান ইমন

  ১৫ অক্টোবর, ২০২১

দামে দম বন্ধ মানুষ

* ১১ পণ্যের মূল্য এক বছরে কয়েকগুণ বেড়েছে * হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ

বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া চাল, ডাল ও তেলের সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে পেঁয়াজ, আটা, ময়দা, মুরগিসহ কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের নাম। এক বছরের ব্যবধানে এসব পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সবাইকে এখন সংসার চালাতে হচ্ছে বড়ই অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে। জীবনযাপন করতে খরচে কাটছাঁট করেও যেন কিছুতেই মিলছে না হিসাব। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা মানুষ, বাজারে পাগলা ঘোড়ার দাপটে চিড়েচ্যাপ্টা হচ্ছে সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের জীবন।

এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারের ভূমিকা সীমিতই থাকছে। তেল-চিনির দাম নির্ধারণ করে দিলেও তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি। কাগজে-কলমে আটকে ছিল। ব্যবসায়ীরা তা বাস্তবায়ন করেননি। তবে সরকারিভাবে (টিসিবির ট্রাকে) কম দামে চাল, ডাল, তেল ও চিনি বিক্রির কার্যক্রমের পরিসরও চাহিদার তুলনায় সীমিত থাকছে। অথচ এখন সরকারের চাল ও নিত্যপণ্য বিক্রির ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্রের সামনে সীমিত আয়ের মানুষের ভিড় সাম্প্রতিক কালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

এক বছরে ১১ পণ্যের দাম বেড়েছে সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য মতে, গত এক বছরে ১১ ভোগ্যপণ্যের কয়েকগুণ দাম বেড়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে তেল ও হলুদের দাম। গত বছরের ১৪ অক্টোবর সয়াবিন তেলের (লুজ) এক লিটারের দাম ছিল ৯০-৯৩ টাকা, যা গতকাল বিক্রি হচ্ছে ১৩৫-১৪০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশ। একই সঙ্গে বোতলজাত তেলেরও। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৪২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। একই অবস্থা হলুদের দাম এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে। এ ছাড়া হলুদের দাম এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে দশমিক ৩৩ শতাংশ; যা গত বছর বিক্রি হয়েছে ১৪০-১৬০ টাকা কেজি।

এ ছাড়া মসলা-জাতীয় পণ্যের মধ্যে এক মাসে পেঁয়াজের (দেশি) দাম বেড়েছে ৪৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত মাসের এই দিনে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪২-৪৫ টাকা কেজি, যা গতকাল বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা কেজি। তবে গত দুই দিন আগেও বিক্রি হয়েছে ৭৫-৮০ টাকা কেজি। দেশীয় আদার ঝাঁজ বেড়েছে ৩৮ দশমকি ৪৬ শতাংশ; যা গত বছরের ১৪ অক্টোবর বিক্রি হয়েছে ১০০-১৪০ টাকা কেজি। লবঙ্গের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩০০-৩৫০ টাকা; যা গত বছর বিক্রি হয়েছে ৭০০-৯০০ টাকায়। একই অবস্থা ডালের বাজারেও। এক বছরের ব্যবধানে মসুর ডালের (বড় দানা) দাম বেড়েছে ২২ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আটা (খোলা) কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৩৪-৩৫ টাকা; যা গত বছর বিক্রি হয়েছিল ২৮-৩০ টাকা। ময়দার দামও বেড়েছে এক বছরে ৩০ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

চিনি (খোলা) গতকাল কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা, যা এক বছর আগেও ছিল ৬০-৬৫ টাকা। একই অবস্থা চালের দামেও। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৩৬ শতাংশ। একই অবস্থা গুঁড়া দুধেও। ডানো এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। ফ্রেশ গুঁড়া দুধ বেড়েছে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ ও মার্কস বেড়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।

দিশাহারা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ

সাদিক রহমান বনশ্রীর একটি অ্যাপার্টমেন্টে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করেন। মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন পান। ছয় হাজার টাকা ঘর ভাড়া আর চার হাজার টাকায় সংসার চালাতেন তিনি। এরমধ্যে তিন হাজার টাকা চাল-ডালসহ মাসের বাজার খরচ আর এক হাজার টাকা ছেলের লেখাপড়ার খরচ করতেন আনিস। কিন্তু এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এত বেশি যে আর এই টাকায় সংসার চালানোই যেন দায়। সাদিক বলেন, ‘করোনার কারণে গত দুই বছরে এক টাকাও বেতন বাড়েনি। তার পরও কষ্ট কইরা সংসার চালাচ্ছি। কিন্তু এখন চাল, তেল, চিনি, আটা, পেঁয়াজ সবকিছুর দাম বেশি। এমনকি মুরগি, ডিম এসবের দামও শুধু বাড়ছে। আমরা গরিব মানুষ দেশি মুরগি তো কেনার কোনো দিন সাহসও পাইনি। খাওয়ার মধ্যে শুধু ডিম আর ব্রয়লার মুরগি খাইতে পারতাম। এখন এটাও সম্ভব না। তেল, চিনির দামও নাগালের বাইরে। সামনে মনে হয় আমাদের শুধু লবণ দিয়া ভাত খাইতে হবে। এই যে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, এটা কি দেখার কেউ নেই। আমাদের তো আর বেতন বাড়ছে না।’

আরিফুল ইসলাম একটি মিষ্টির শোরুমে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘করোনা শুরু হওয়ার কিছুদিন পর কোম্পানি বেতন কমিয়ে দেয়। কিন্তু বেচাকেনা আগের মতো নেই। তাই মালিক আগের চেয়ে কম বেতন দিচ্ছেন। আগে বেতন পাইতাম ১৪ হাজার টাকা আর এখন পাই ১১ হাজার। একদিকে জিনিসপত্রেরর দাম বাড়ছে আর অন্যদিকে বেতন কমছে। সংসারের হিসাব কেমনে কী করি? আমার মেসে সিট ভাড়া ও খাওয়া বাবদ খরচ ৫ হাজার টাকা। বাড়িতে পাঠাই সাত হাজার টাকা। যে টাকা বাড়িতে দেই, তা দিয়ে সংসার চালানো দায়।’

তবে এ বিষয়ে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে কার্যকর হয়নি। যে বা যারা কার্যকর করবে, তারা ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে ভোক্তারা সুফল পায়নি। তাই মনিটরিং সংস্থার আদেশ কার্যকর করতে কঠোর হতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যতবার পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, ঠিক তখন থেকেই দাম কার্যকর করতে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সারা দেশের বাজার তদারকি করা হয়েছে। এখনো করা হচ্ছে। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণে আসতে দেরি হয়। কারণ যে খুচরা বিক্রেতা পাইকারি বা মোকাম থেকে বেশি দামে পণ্য কিনে দোকানে মজুদ করেছেন, সেই পণ্য বেশি দরে বিক্রি করেছেন। লস দিয়ে বিক্রি করেননি। যে কারণে দাম কমতে একটু দেরি হয়েছে। তবে সরকারের বেঁধে দেওয়া দর কার্যকরে অধিদপ্তরের মনিটরিং সদস্যরা কাজ করেছেন। এখনো করছেন। এ ছাড়া অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে তদারকি করা হচ্ছে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close