গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৪ অক্টোবর, ২০২১

গ্রাহকদের সঙ্গে মোবাইল কোম্পানির ছলচাতুরী

কলড্রপের ক্ষতিপূরণ দেওয়া না দেওয়া নিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে মোবাইল কোম্পানিগুলোর ছলচাতুরী ফাঁস হয়ে গেছে। দেখা গেছে, প্রতি কলড্রপের বিপরীতে ১ মিনিট কল ফেরত দিতে হয়। কিন্তু অপারেটরগুলো তা না দিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। এ নিয়ে বিটিআরসির সঙ্গেও করছে লুকোচুরি খেলা। দীর্ঘদিন থেকে গ্রাহকদের অভিযোগ ও বিটিআরসির নির্দেশনা উপেক্ষা করে দিব্যি কলড্রপ ঘটিয়ে হজম করে গেছে কোম্পানিগুলো। সম্প্রতি গ্রাহকদের অভিযোগের ভিত্তিতে বিটিআরসি জরিপে নেমে এই অপারেটরগুলোর কলড্রপের অনিয়ম খুঁজে পায়। এর ভিত্তিতে তারা অপারেটরদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে তৎপর রয়েছে।

সূত্র মতে, গ্রামীণ ৭টি কলড্রপের বিপরীতে দেখা গেছে ১ মিনিট ফেরত দিয়েছে। রবি আজিয়াটা একাধিক কলড্রপের বিপরীতে মাত্র একজন গ্রাহককে দিয়েছে কলফেরত। আর বাংলালিংক দিয়েছে বোনাস অ্যাকাউন্টে। সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেইন অ্যাকাউন্ট থেকে আবার কেটে নিয়েছে। এভাবেই নানা অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে কোটি কোটি মিনিট কলড্রপ ঘটিয়ে গ্রাহকের পকেট ফাঁকা করেছে। প্রতি কলড্রপের বিপরীতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) থেকে সমপরিমাণ মিনিট-ফেরতের নির্দেশ থাকলেও তাও আবার অপারেটরগুলো মানেনি।

একজন গ্রাহক এক মিনিট কথা বলার জন্য ৬০ পয়সার বেশি বিনিয়োগ করলেও কলড্রপসহ নেটওয়ার্ক ঝামেলায় মিনিটপ্রতি খরচ হয়েছে এক টাকা। রবি, গ্রামীণ ও বাংলালিংকে দেখা গেছে, কলড্রপ ঘটিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে এক বছরেই প্রায় ৫০ কোটি মিনিট, যা টাকার মূল্যে আসে ৩০ কোটির বেশি। এ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘কলড্রপের সার্বিক বিষয় নিয়ে আমরা জরিপ করেছি। অসংগতি পেয়েছি। তাই তাদের ডেকে সতর্ক করে দিয়েছি। বিটিআরসি সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে।’

জানতে চাইলে বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, কলড্রপের ক্ষেত্রে বিটিআরসির জারি করা নীতিমালা অনুযায়ী প্রত্যেক গ্রাহককে কল মিনিট-ফেরত দিতে হবে। প্রতিদিনের কলড্রপের ফলে ফেরতযোগ্য মিনিটসমূহ একত্রে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত দিয়ে এসএমএসের মাধ্যমে গ্রাহককে অবহিত করতে হবে। কোনো অপারেটর এ নিয়মের ব্যত্যয় করলে আইন ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যোগ করেন বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিটক প্রযুক্তি অক্ষমতায় কলড্রপ নির্ণয় করতে পারেনি। তবে বেসরকারি তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কলড্রপে রেকর্ড গড়েছে রবি আজিয়াটা। এই অপারেটরের অন ও অফ নেট মিলিয়ে সর্বোচ্চ কলড্রপ ৩১ কোটি ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৫১ মিনিট। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা গ্রামীণের কলড্রপের পরিমাণ ১৩ কোটি ৯৮ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮ মিনিট। কলড্রপে তৃতীয় অবস্থানে বাংলালিংক। এই অপারেটরের কলড্রপের হার ৩ কোটি ১ লাখ ৭০ হাজার ২৮১ মিনিট। তবে, কলড্রপের বিপরীতে গ্রাহকদের ফেরত দিয়েছেন এক-তৃতীয়াংশ মিনিট।

ফোন কোম্পানির গোপন নথির তথ?্য বলছে, গ্রাহককে কলড্রপের এক-তৃতীয়াংশ ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এই যৎসামান?্য ক্ষতিপূরণ তাও অন নেটে অর্থাৎ (জিপি টু জিপি, বাংলালিংক টু বাংলালিংক এবং রবি আজিয়াটা টু রবি আজিয়াটা)। আর অফ নেটে এক কানাকড়িও ক্ষতিপূরণ দেয়নি অর্থাৎ (জিপি টু বাংলালিংক এবং রবি টু জিপি)। এই ক্ষতিপূরণ না দিতেও তলে তলে চালাচ্ছেন নানা ফন্দিফিকির।

তথ?্যানুযায়ী, ক্ষতিপূরণ পাওয়া এক-তৃতীয়াংশ বিভিন্ন অপারেটরের শতাধিক মোবাইল ব?্যবহারকারীর সঙ্গে কথা বলে এমন একজন গ্রাহকের সন্ধান পাওয়া যায়নি; যিনি কলড্রপের ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা, অনেকেরই ধারণা নেই কলড্রপ সম্পর্কে; এমন অভিযোগ করেছে গ্রাহকের বড় একটি অংশ।

রাজধানীর শান্তি নিকেতনের বাসিন্দা মো. কামরুজ্জামান রবি আজিয়াটার গ্রাহক। তিনি বলেন, কথা বলতে বলতে হঠাৎ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কিন্তু জানা মতে আজ পর্যন্ত কোনো ফ্রি মিনিট পেয়েছিলাম আমার মনে পড়ছে না। উল্টো অভিযোগ করে এই গ্রাহক বলেন, কলড্রপের জন্য অভিযোগ জানাতে গেলেই এই অপশন, ওই অপশন চাপুন বলতে বলতে দেখা গেছে, যতটুকু ব্যালেন্স মোবাইলে ছিল সেটিও শেষ হয়ে গেছে।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বাসিন্দা মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি শুরুতেই গ্রামীণের গ্রাহক ছিলাম। কলড্রপে বিরক্ত হয়ে বাংলালিংক নিলেও একই অবস্থা। কলড্রপ কী এবং কেন হয় ধারণা নেই তার। তবে, শতাধিক গ্রাহকের মধ্যে রবির একজন গ্রাহকের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওই গ্রাহকের নাম ইমন। তিনি রাজধানীর বনশ্রীতে থাকেন।’

রবি সিম ব্যবহারকারী এই গ্রাহক বলেন, জীবনে কলড্রপের কারণে একবারই এক মিনিট কল ফেরত পেয়েছিলেন। এরপর রবির পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যবহার করলেও কলড্রপের কারণে কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি তিনি।

এদিকে, বেসরকারি মোবাইল কোম্পানিগুলো ক্ষতিপূরণ গ্রাহককে দিয়েছে, না-কি দেয়নি, তার একটি তথ?্য পেলেও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিটক রয়েছে অন্ধকারে। তাদের ভাষ?্য মতে, কলড্রপ নির্ণয়ে তারা অক্ষম। এখন পর্যন্ত একজন গ্রাহক তাদের থেকে কলড্রপের ক্ষতিপূরণ পায়নি।

আবার টেলিটকের মতো জিপি, রবি ও বাংলালিংক কারিগরি ত্রুটি দেখিয়ে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত অফ নেটে কতগুলো কলড্রপ হয়েছে, তা সুকৌশলে তারা এড়িয়ে গেছে।

এভাবেই গ্রাহকদের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) চোখে ধোঁয়া দিতে অপারেটরগুলো নিয়েছেন নানা ছলচাতুরীর আশ্রয়। কিন্তু বিটিআরসি গ্রাহকের স্বার্থে অপারেটরগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা ফেরাতে রয়েছে তৎপর। খবর বিটিআরসি ও অপারেটর-সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মোবাইল কোম্পানিগুলো কৃত্রিম নেটওয়ার্ক দুর্বলতা দেখিয়ে কথা চলার বিঘœ ঘটিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্নের নামে গ্রাহককে ঠকানো শুরু করে। দিনের মধ্যে কয়েকবার এ সংকট সৃষ্টি করে গ্রাহকের ব?্যালেন্স খুইয়ে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। ত?্যক্ত-বিরক্ত গ্রাহক অপারেটরগুলোর জারিজুরি সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস করে দেয়। বিটিআরসি তা খতিয়ে দেখে অনিয়মের তথ?্য পায়।

সর্ব প্রথম ২০১৬ সালের ৩০ জুন মোবাইল কোম্পানির উদ্দেশ্যে বিটিআরসি এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে। বলা হয়, কোনো মোবাইল সংযোগ (এমএসআইএসডিএন) দৈনিক একের অধিক প্রতি কলড্রপের জন্য গ্রাহককে ১ মিনিট ফেরত এবং সেটি এসএমএসের মাধ?্যমে জানিয়ে দিতে হবে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কলড্রপের জন?্য ফেরত টকটাইমের ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ ১০ সেকেন্ড পাল্স প্রযোজ?্য এবং মেয়াদকাল হবে ১ মাস।

কলড্রপের পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে (জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২১) অন নেটে গ্রামীণফোন ব?্যবহারীরা কলড্রপের শিকার হয়েছেন ১৩ কোটি ৯৮ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮ মিনিট। এর বিপরীতে গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া মিনিটের পরিমাণ ৫ কোটি ৫৬ লাখ ২৮ হাজার ৯২২ মিনিট অর্থাৎ মোট ক্ষতির এক-তৃতীয়াংশ। এই অপারেটরের গ্রাহকরা অফ নেটে (অন?্য অপারেটরে ফোন করে) ২০২০ সালের জুলাই-আগস্ট দুই মাসে কলড্রপের শিকার হন ২৭ লাখ ৫৪ হাজার ৬৬৯ মিনিট।

একইভাবে গত এক বছরে (জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২১) অন নেটে রবি আজিয়াটা ব?্যবহারীরা কলড্রপের শিকার হয়েছেন ৩১ কোটি ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৫১ মিনিট। এর বিপরীতে গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া মিনিটের পরিমাণ ৫ কোটি ৩৭ লাখ ৪১ হাজার ১৬৭ মিনিট অর্থাৎ ক্ষতির ছয় ভাগের এক-তৃতীয়াংশ। এই অপারেটরের গ্রাহকরা অফ নেটে (অন?্য অপারেটরে ফোন করে) ২০২০ সালের জুলাই-আগস্ট দুই মাসে কলড্রপের শিকার হন ১০ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার ৩৪৪ মিনিট।

এ ছাড়া গত এক বছরে (জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২১) অন নেটে বাংলালিংক ব?্যবহারী গ্রাহকরা কলড্রপের শিকার হয়েছেন ৩ কোটি ১ লাখ ৭০ হাজার ২৮১ মিনিট। এর বিপরীতে গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া মিনিটের পরিমাণ ১ কোটি ৫২ লাখ ৯৭ হাজার ৭২১ মিনিট অর্থাৎ ক্ষতির এক-তৃতীয়াংশ।

প্রতিদিনের কলড্রপের ফেরতযোগ্য মিনিট পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেওয়া, ফেরত মিনিটের তথ্য এসএমএসের মাধ্যমে গ্রাহককে জানানো, কলড্রপের ফেরত মিনিট ব্যবহারে জন্য গ্রাহক সময় পাবেন ৩০ দিন এবং অন নেট কলের ক্ষেত্রে ওপরের সব বিধান প্রযোজ্য হবে। এ ছাড়া টেলিটককে কলড্রপেরে মিনিটের তথ্য সংগ্রহ করার কারিগরি সক্ষমতা অর্জন করা এবং কলড্রপের বিপরীতে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আগামী তিন মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে বিটিআরসি।

মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (এমটব) মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফরহাদ (অব.) প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, মোবাইলসেবায় কলড্রপ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির সাহায্যে এই সেবা দেওয়া হয় বলে নানা কারণে কলড্রপ হতে পারে। তবে নেটওয়ার্কের ত্রুটিই কলড্রপের একমাত্র কারণ নয়। তা ছাড়া আমাদের দেশে গ্রাহক অনুপাতে সেবাদাতাদের কাছে যে তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়া আছে তা পর্যাপ্ত নয়। মোবাইল অপারেটররা সরকারের বেঁধে দেওয়া নিয়মের মধ্য থেকেই তাদের সেবা দেওয়া হয়ে থাকে। সেই নীতি অনুসরণ করে তারা কলড্রপের বিপরীতে গ্রাহকের কল মিনিট ফেরত দিয়ে থাকে।

জানতে চাইলে বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটির আংকিত সুরেকা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আমরা গ্রাহকদের যেকোনো অভিযোগ অনেক গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করি এবং তা সমাধানের চেষ্টা করি। এজন্য আমরা নতুন টাওয়ার প্রতিস্থাপন ও নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণেও গুরুত্ব আরোপ করছি।’

এদিকে রবির মিডিয়া শাখার কর্মকর্তা জামান আশরাফ মন্তব্য না দিয়ে উল্টো তথ্য সরবরাহকারীর নাম জানতে চেয়ে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন। আর গ্রামীণের মিডিয়া উইংয়ের কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসান লিখিত বক্তব্য পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রাখেননি।

কলড্রপের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ তত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘ভোক্তা অধিকার বলতে আমরা যেটা বুঝি সেটা হচ্ছে, সেবাটা হবে নিরবচ্ছিন্ন। মোবাইল অপারেটরদের বিটিআরসি থেকে একটা নির্দেশনাও দেওয়া আছে, যদি নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে না পারেন তার ক্ষতিপূরণ আপনি গ্রাহককে বুঝিয়ে দেবেন। কিন্তু না দেওয়ার মানসিকতাটাই অপরাধ।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close