নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

পরিকল্পনা ফাঁস জামায়াতের

সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে ২০৪৮ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা এঁটেছিল মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রথম লক্ষ্য ছিল সরকারি ২৫টি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ২ লাখ সদস্য নিয়োগ করার। সম্প্রতি জামায়াত-শিবিরের নেতাদের রিমান্ডে নিয়ে এ তথ্য জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা পুলিশ সারা দেশে প্রায় ৪০০ ট্রেড ইউনিয়নের তথ্য পেয়েছে, যেগুলো জামায়াতে ইসলামীর পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয়েছে।

এর আগে ২০১৪ এবং ১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেও ব্যাপক সহিংসতা এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল দলটি। ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেওয়া, নির্বাচনী কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যা করেছে তারা। এবার আরেকটি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আবার তারা ষড়যন্ত্র করছে বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ক্ষমতালিপ্সায় যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটি তৈরি করেছে ত্রিশশালা পরিকল্পনা। দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নে নানা রকম ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে নিজেদের কর্মী সংগ্রহ করছে নিবন্ধন হারানো দলটি। টার্গেট করা হচ্ছে তরুণ প্রজন্মকে।

২০১৩ সালে একটি রিটের রায়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্ট। ২০১৮ সালে দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধা দলটি সবশেষ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে অংশ নিতে পারলেও রাজনীতিতে ফেরার বিভিন্ন পথ খুঁজছে দলটি।

চলতি মাসের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে। দুদফা তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দা পুলিশ। রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়ার দাবি গোয়েন্দাদের।

সূত্র আরো জানায়, ২০১৮ থেকে ২০৪৮ পর্যন্ত ত্রিশশালা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। ভিশন-৪৮ সামনে রেখে পাঁচটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়েছে দলটি। পরিকল্পনায় সরকারের ২৫টি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ২ লাখ কর্মী নিয়োগ করা হবে। তাদের মূল টার্গেট দেশের, কৃষক শ্রমিকসহ খেটে খাওয়া মানুষ। টার্গেট করা হয়েছে তরুণ প্রজন্মকেও। জামায়াত পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কলেবর বৃদ্ধি করা হবে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, তারা (জামায়াত) দেশে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করেছে, যেখানে বিদেশ থেকে ফান্ড এনে তারা মূলত দলের জন্য ব্যবহার করছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল দল তৈরি করে ছাত্রলীগের মধ্যে তাদের প্রবেশ করিয়ে দেওয়া। এরই মধ্যে কতিপয় মানুষকে তারা হেফাজতের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এভাবে তারা গোপন তথ্য সংগ্রহ করে, তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে যাওয়া।

মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, দলটির মূল টার্গেট ছিল একদিকে আওয়ামী লীগ সেজে তাদের অর্জন বিনষ্ট করা, অন্যদিকে বিভিন্ন অরগানাইজেশনের সঙ্গে মিলেমিশে একত্র হওয়া। বসুন্ধরায় তারা মিলিত হয়েছিল সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই।

প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে ঘোষিত জামায়াত নেতাদের ৬টি মামলার রায়েই জামায়াতকে অতীত কর্মকা-ের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। উল্লেখ করা হয়েছে সন্ত্রাসী ও অপরাধী সংগঠন হিসেবে। একাত্তরে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয়কালে মুক্তিকামী মানুষকে নির্বিচার হত্যা করে জামায়াতের নেতাকর্মীরা। মানুষের সহায় সম্পদ ধ্বংস করা ছাড়াও সর্বাত্মকভাবে স্বাধীনতার বিপক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় তারা।

দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ে তাদের সহযোগী শক্তি হিসেবে জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের বিচার চলছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু রায় হয়ে গেছে। অপেক্ষায় আরো কয়েকটি।

বিতর্কের মধ্যেই জন্ম জামায়াতের : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, যার পূর্বনাম ছিল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী সূচিত সংগঠনটির মূল নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট এর প্রতিষ্ঠা।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানির অভিযোগে প্রথমবার পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৫৯ সালে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পরিবার আইনের বিরোধিতার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা- আবার নিষিদ্ধ হয়। দলের প্রধান মওদুদীসহ গ্রেপ্তার করা হয় ৬০ জামায়াত নেতাকে। এই ৬০ জনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের যে ১৩ জন জামায়াত নেতা ছিলেন তাদের অন্যতম গোলাম আযম।

মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করে জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে দলটির সদস্যরা হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, সংখ্যালঘু নির্যাতন, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা, ১৪ ডিসেম্বর ডিসেম্বর বুধিজীবী হত্যাকা-ে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধমূলক কর্মকা-ে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। দেশ স্বাধীন হলে দলটির প্রধান গোলাম আযম পাকিস্তানে আশ্রয় নেন। অন্যদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালান ও বাকিদের দালাল আইনে গ্রেপ্তার হয়।

স্বাধীন দেশে জামায়াতে ইসলামী : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। এ বছরেই অধ্যাদেশের মাধ্যমে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে এই বিবেচনায় জামায়াতও রাজনীতির অধিকার হারায়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হলে জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন।

১৯৭৬ সালের আগস্টে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার রাজনীতি উন্মুক্ত করে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা করেন। এ সময় ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে একটি দলের ছত্রচ্ছায়ায় জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে কর্মকা- পরিচালনা শুরু করে। জেনারেল জিয়ার সরকার এ সময় গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়। ১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ দেশে আবার আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকা- শুরু করে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close