আরমান ভূঁইয়া

  ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

কিশোর গ্যাংয়ে মাদকের স্বার্থ

মাদকাসক্ত, ছিনতাই, ধর্ষণ ও খুনের মতো ভয়াবহ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে দেশের কিশোররা। পাড়া-মহল্লায় নামে-বেনামে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। রাজধানীতে শতাধিক গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসার স্বার্থ এবং তরুণদের প্রেমের ঘটনা নিয়েও সংঘর্ষে জড়ায় এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এতে রক্ত ঝরে, প্রাণ যায়, ঘটে এলাকার সম্পত্তিনাশের মতো ঘটনা। জানা গেছে, বখে যাওয়া কিশোর অপরাধীদের এসব চক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় স্থানীয় রাজনৈতিক বড় ভাইরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছে, কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির প্রধান কারণ সন্তান লালন-পালনে পারিবারিক সচেতনতার অভাব, সামাজিক অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক প্রভাব।

কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। গত বৃহস্পতিবার মগবাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান কামাল কমপ্লেক্সে ‘সবার হোক একটাই পণ, কিশোর অপরাধ করব দমন’ শিরোনামে কিশোর অপরাধবিরোধী সামাজিক প্রচারণা কার্যক্রম ও র‌্যাব নির্মিত টিভিসি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আইজিপি এসব কথা বলেছেন। তিনি বলেন, গত ৩ বছর ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রেক্ষাপটে কিশোর গ্যাং একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

আইজিপি আরো বলেন, ‘কিশোর গ্যাং সদস্যদের বিরুদ্ধে এর আগে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বর্তমান আইনের কারণে এখন আর সেভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। এ ছাড়া কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের (বা-মায়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা) বিষয়টি রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ দরকার। কমিউনিটির একাত্মতার মাধ্যমে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ জরুরি।’

পুলিশ ও র‌্যাব সূত্র বলছে, রাজধানীতে এখন অন্তত ৭০ থেকে ৭৫টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। এদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্য মতে, কেন্দ্রে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ হত্যা এবং ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে ৮২১টি মামলায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১ হাজার ১৯১ কিশোর। পুলিশের তালিকা অনুযায়ী রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে মিরপুর এলাকায়। আর সবচেয়ে কম গুলশানে। এছাড়া তেজগাঁও বিভাগে যথাক্রমে ১৪টি, মিরপুরে ২৩, উত্তরায় ১১, গুলশানে ১, ওয়ারীতে ৬, মতিঝিলে ১১, রমনায় ৮ এবং লালবাগে ৪টি গ্রুপ রয়েছে। এর মধ্যে সিংহভাগ কিশোরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে মামলা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এটি চূড়ান্ত তালিকা নয়। প্রতিনিয়ত থানাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম।

মূলত ২০১৭ সালে উত্তরায় আদনান হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের সহিংসতার আলোচনায় আসে। ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কের ওপর আদনান কবিরকে (১৪) ধারালো অস্ত্র ও হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মকভাবে হত্যা করে সংঘবদ্ধ (ডিসকো বয়েস, বিগবস ও নাইনস্টার) গ্যাং। র‌্যাব জানায়, ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ৩৭৪ জন কিশোর গ্যাং সদস্যকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে।

কিশোর গ্যাংয়ের কাছে দেশি অস্ত্রের ছড়াছড়ি। এমনকি তাদের কাছে রয়েছে অত্যাধুনিক বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা খুন, ছিনতাই-চাঁদাবাজি, শ্লীলতাহানি, ইভটিজিং ও মাদক ব্যবসার মতো অপরাধে বেশি জড়িয়ে পড়ছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে বলছে, ২০১৯ সালে নানা কারণে সারা দেশে ১৮ বছরের নিচে খুন হয় ১০৩ জন। আর ২০২০ সালে খুন হয় ৭ থেকে ১২ বয়সি ১২৪ জন। জানা গেছে, গত ১৭ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০ জন খুন হয়েছে। এর মধ্যে গত দুই বছরে খুন হয়েছে ৩৪ জন। আর এসব ঘটনায় চার শতাধিক কিশোরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে শারীরিক চর্চার অভাব, বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহার, বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্টতা ও তা অনুকরণ, সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক প্রেক্ষাপটে পারিবারিক অনুশাসন কমে যাওয়া, কথিত রাজনৈতিক বড় ভাইদের প্রশ্রয়কে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, পারিবারিক শাসন অনেকটাই কমে আসাও এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। অধিকাংশ পরিবারে দেখা যায় বাবা-মা দুজনই চাকরি করেন। ফলে সন্তানের প্রতি তাদের যে দায়িত্ব পালন করার কথা সেটা হচ্ছে না। এতে করে সন্তানরা সহজে বিপথগামী হয়ে পরছে।

একইভাবে কিশোরদের অপরাধে জড়ানোর পেছনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ কমে যাওয়াকেও দায়ী করছেন অধ্যাপক জিয়া রহমান। তিনি বলেন, এখন এলাকাভিত্তিক সামাজিক কার্যকলাপ নেই বললেই চলে। যা আছে তাতে কিশোরদের অংশগ্রহণ করার ?সুযোগ খুব কম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে না, খেলার মাঠ কমে এসেছে। সামাজিকভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন না থাকায় কিশোররা সাইবার জগতে বুঁদ হয়ে আছে। তারা সেখান থেকেই যা শিখছে তা প্রয়োগ করতে গিয়ে বিপথগামী হচ্ছে। এই প্রযুক্তি শুভ ব্যবহার আমরা তাদের শেখাচ্ছি না। ফলে অপরাধ বেড়ে চলছে।

অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিক বড় ভাইরা তাদের মাদক কারবার বিস্তৃত রাখতে ও রাজনৈতিক মিছিল, সভা-সমাবেশে কিশোরদের প্রয়োগের ফলেও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রেণে এখনই সক্রিয় ভূমিকা না নিলে দিন দিন তা ভয়ংকর আকারে রূপ নেবে। তিনি আরো বলেন, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের উত্তোলন গবেষণা করা আছে। তবে প্রয়োগ নেই। আর এটি রাতারাতি নির্মূল করা সম্ভব নয়। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, পরিবার ও সমাজকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।

ঢাকা আহ্সানিয়া মিশনের অ্যাডভোকেসি এবং কমিউনিকেশন এক্সপার্ট আজমি আক্তার বলেন, অপরাধে জড়িত কিশোরদের বিরাট অংশ নিম্নবিত্ত পরিবারের। রাজধানীসহ দেশের ছোট-বড় শহরে দরিদ্র পরিবারের লাখ লাখ কিশোর বড় হয় অযত্ন-অবহেলায়। তারা রেলস্টেশন, লঞ্চ-টার্মিনাল, অফিসের বারান্দা, এমনকি ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে জীবন কাটায়। তিনি বলেন, হাজারীবাগ, হেমায়েতপুর, ভৈরব এ চামড়া শিল্পের সঙ্গে জড়িত ৪০০ শিশুর জীবন কাহিনী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিশুশ্রমের সঙ্গে কিশোর অপরাধ এবং মাদকাসক্তির একটা সম্পর্ক আছে। তাদের অভিভাবক মনে করে গরিব এবং বস্তিতে থাকা শিশুরা কাজে না গেলে অপরাধে ও মাদকাসক্তির সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। এ সুযোগে মাদক কারবারিরা পথ শিশু এবং কর্মজীবী শিশুদের তাদের ব্যবসায় যোগদানের প্রলোভন দেখায়। অর্থ লোভে অজান্তেই অনেক শিশু কিশোর অপরাধ এবং মাদকের কারবারে জড়িয়ে যায়। কিশোর গ্যাংগুলোর অর্থের জোগান হয় মূলত মাদকের কারবার থেকেই। মাদক চোরাকারবারিরা এলাকায় নিজেদের প্রভাব বলয় গড়ে তুলতে কিশোর গাংয়ের পেছনে টাকা খরচ করে, আবার এই কিশোরদের মাদকাসক্ত করে এই মাদক কারবারিরাই। এতে একজন উঠতি তরুণ তার ‘এলাকার বড়ভাই’ মাদক কারবারির ওপর নির্ভশীল হয়ে পরে। এভাবেই তরুণটির জীবন শেষ হয়ে যায়, তার পরিবারকে ভোগ করতে হয় কষ্ট, সামাজিক গঞ্জনা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close