গাজী শাহনেওয়াজ, সাতক্ষীরা (শ্যামনগর ) থেকে ফিরে

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

জীবন যেখানে দুর্বিষহ

জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব আগেই মানিয়ে নিয়েছেন তারা। তবে রক্ষা মিলছে না অর্থলোভী মানুষের ভয়াল থাবা থেকে। মিথ্যা আশ্বাস ও জোড়াতালি দিয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কারের কারণে এখন ভয়াবহ ক্ষতির মুখে তারা। ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসের পর ভারী জোয়ারেই ভেঙে যাচ্ছে বাঁধ। মাসের পর মাস থাকছেন পানিবন্দি। নানা দুঃখ-কষ্টে কাটছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার বিচ্ছিন্ন দুই ইউনিয়ন পদ্মপুকুর ও প্রতাপনগরের মানুষের জীবন।

এই দুই ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় নিচিহ্ন হয়ে গেছে শৌচাগার। ঝুলন্ত শৌচাগারও খুঁজে পাওয়া যায়নি আধা কিলোমিটারের মধ্যে। তাই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এখানকার মানুষগুলো অপেক্ষা করতে হয় সন্ধ্যার জন্য। দিনভর শারীরিক এই যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানো কষ্টের কথা উঠে এসেছে বারবার। শারীরিকভাবে অসুস্থ ও নারীরা রয়েছেন বিব্রত অবস্থার মধ্যে। এসব পানিবন্দি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা স্বীকার করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও।

পদ্মপুকুর ইউনিয়নের উপকূলীয় এলাকায় কথা হয় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র তামিম হোসেনের (১২) সঙ্গে। বেড়িবাঁধ ভাঙনে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে জানতে চাইলে তামিম বলে, স্কুলও পানিতে তলিয়ে আছে। খেলাধুলা করব সামান্য জায়গা নেই; চারদিকে পানি আর পানি। অনেকটা লোকলজ্জা এড়িয়ে তামিম ইতস্তত করতে করতে জানায় সবচেয়ে সমস্যা মলত্যাগে। এটার জায়গা নেই; পানিতে ভেসে গেছে। দিনে চেপে রাখি। সন্ধ্যার পর সেরে নেই। এভাবেই চলছে মাসের পর মাস।

এ দিকে, স্থানীয় চেয়ারম্যানরাও সাহায্য দেওয়ার ভয়ে পালিয়ে বেড়ান বলে জানান আশরাফ (৪০) নামে বন্যাতোলা গ্রামের এক বাসিন্দা। আপনাদের মলত্যাগ করার জায়গা কোথায় জানতে চাইলে জেনি নামে একজন মধ্যবয়স্ক নারী শাড়ির আঁচল টেনে দ্রুত অন্যত্র চলে যান। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্টু (২৬) নামে একজন বলেন, ওই কথা জ্ঞিজ্ঞেস করা আপনার উচিত হয়নি। উনি ‘শরম’ পেয়েছেন। কারণ এখানে দিনে কেউ মলত্যাগ করে না অপেক্ষা করতে হয় অন্ধকারের জন্য।

আশাশুনি উপজেলা চেয়ারম্যান এ বি এম মোস্তাকিম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হলে তো কিছুই ভালো থাকে না। শুধু স্যানিটেশন না; বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট হয়। এ দুটিই মানুষের সুস্থ থাকার জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ইয়াসের আগে বাঁধ ভাঙলে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করানোর জন্য আমার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে এক লাখ টাকা দিয়েছিলাম। নতুন করে সম্প্রতি নির্মিত বাঁধটি আবার ভেঙে গেছে। আমার পক্ষ থেকে পাউবোকে বার বার বলেছি, বাঁধ নির্মাণে মনোযোগ দেওয়ার জন্য। তারা আমাদের আশ্বাস দিচ্ছে, করবে করবে এভাবেই সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ শুরুর জন্য স্থানীয় সাধারণ মানুষদের উদ্বুদ্ধ করছি, তোমরা কাজ ধরো টাকা আমি ব্যবস্থা করব। কয়েক দিনের মধ্যে কাজ শুরু হবে।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ ন ম আবু জাফর গিফারী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, নদীর বাঁধ ভাঙলে এলাকা প্লাবিত হবে। মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ ছাড়া উপকূলীয় মানুষের এই দুর্ভোগ কমবে না। এ ধরনের দুর্যোগে স্যানিটেশনের ব্যাপক সমস্যা তৈরি হয়, যা পদ্মপুকুরসহ ভাঙনকবলিত এলাকায় রয়েছে। তবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আমরা দুর্যোগকবলিত এলাকায় কিছু মানুষের মধ্যে মোবাইল টয়লেট বিতরণ করেছি। সেগুলো ব্যবহারের উপযোগী আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে। শ্যামনগর উপজেলার স্থানীয় এনজিও লির্ডাসের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, উপকূলীয় ভাঙন এলাকা। উপকূলীয় মানুষের স্যানিটেশন ব্যবস্থা নাজুক। মাটির ওপরে এটা করা হয়। বাঁধ ভেঙে গেলে কিংবা জলোচ্ছ্বাস বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেগুলো পানিতে মিশে একাকার হয়ে যায়। এখন দরকার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ। একই সঙ্গে দরকার এমন কিছু শৌচাগার যা নদীভাঙনেও টিকে থাকবে। এরই মধ্যে লির্ডাসের পক্ষ থেকে উপকূলীয় এলাকা গাবুরা, কাশিমারী ও আশাশুনিতে টেকসই ৪৫০টি টয়লেট তৈরি করে দিয়েছি। চলতি বছরে ইয়াসে আঘাতেও নির্মিত টয়লেটগুলো অক্ষত আছে। এগুলো রেজুলেন্ট টয়লেট বলা হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close