শেখ নজরুল ইসলাম

  ০৫ আগস্ট, ২০২১

মন্তব্য প্রতিবেদন

নান্দনিক হোক সমাজজীবন

করোনা উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ মাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে দশম শ্রেণির এক ছাত্রী। সেখানে মায়ের মৃত্যু হলে মহাখালী কোভিড হাসপাতালে মেয়ের কান্নায় আশপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। উপস্থিত সবার অন্তর কেঁদে ওঠে মর্মস্পর্শী আর্তনাদে। জাতীয় সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি বেশ ফলাও করে ছাপা হয়।

একইদিনে আরো একটি সংবাদ সবার দৃষ্টি কাড়ে। পাইকগাছায় বৃদ্ধ বাবা-মাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ঘটনার বিবরণে প্রকাশÑ সন্তানরা বৃদ্ধ বাবা-মাকে বাসা থেকে বিতাড়িত করতে এখানে ফেলে রেখে যায়। ঘটনাটি স্থানীয়দের কাছে অমানবিক মনে হওয়ায় তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে খবর দেন। তিনি সেখানে গিয়ে সব পক্ষের কথা শোনার পর বড় ছেলের কাছে ওই বৃদ্ধ দম্পতিকে হস্তান্তর করেন। শুধু তা-ই নয়, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ এক মাসের খাবার দেন ওই কর্মকর্তা।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। বাকি তিন ছেলেকে জেলের ভাত খাওয়ানোর সব ব্যবস্থাও পাকাপোক্ত করেছেন তিনি। এটা সবারই জানা, আমাদের দেশের অনেকের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। আর গ্রামীণ জীবনে সেই অবস্থা আরো কিছুটা নাজুক। এর ওপর দেড় বছর ধরে চলা করোনার প্রভাবে মানুষের অবস্থা কতটা খারাপ তা কারো অজানা নয়। তাই বলে আমরা অমানুষ হয়ে যাব!

পশ্চিমা সমাজ আর আমাদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। পরিষ্কার করে বলা যায়, আমরা বরাবর সমাজের অনেক ভালো কিছু ধারণ করছি এবং করে চলেছি। পৃথিবীর অনেক সমাজ থেকে যৌথ পরিবার বিদায় নিয়েছে। অনেক দিন পারিবারিক বন্ধন থেকে দূরে থাকার পর এখন তারা আবার সুর পাল্টাতে শুরু করেছেন। তারা বলছেন আগেই ভালো ছিল। আমাদের সমাজে পাশ্চাত্য আধুনিকতার (বন্ধনহীনতার) সেই ঢেউ যে লাগেনি তাও নয়। বারবার মানুষ ‘হেথা নয় সেথা নয় অন্য খানে’ করতে গিয়ে শেষমেশ বন্ধনের সন্ধানে আজ মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফলে ঘুরেফিরে সেসব পুরোনো কিছুর পেছনেই আবার ফিরে যাওয়া।

করোনাকালে পৃথিবীর এমন কোনো জনপথ নেই যেখানে তার থাবা পড়েনি। অনেকে সহায়-সম্বল হারিয়েছেন। জীবনের অনেক ছন্দপতন হয়েছে। প্রথমদিকে মানুষ করোনাভাইরাস থেকে পালিয়ে বেড়ালেও আমরা এখন দেখতে পারছি মানুষ তার স্বজনের পাশেই ফিরে এসেছে। তাদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছে। ভয়াবহ অবস্থাকেও মেনে নিয়ে মানুষ সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করছে। সেখানে দারিদ্র্য মানুষকে মানবিক হতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

আবার এর বিপরীত চিত্রও এসেছে। একই সমাজে এমন বৈপরীত্য! এ যেন মেনে নেওয়া যায় না। জাতি হিসেবে আমরা তো এত অমানবিক নই। যে সন্তানের জন্য বাবা-মা তাদের সবকিছু ত্যাগ করতে পারেন। যাদের জন্য বাবা-মা কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন। সেই সন্তানরা যখন একত্র হয়ে রাতের আঁধারে বৃদ্ধ বাবা-মাকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারে। রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিতে পারে! এর কোনো বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। এদের বিরুদ্ধে কোনো বলপ্রয়োগ করার চিন্তাও ইতিবাচক নয়। কেননা এরা এখন আর মানবপর্যায়ে নেই। মানবতা এদের স্পর্শ করতেও ঘৃণাবোধ করে।

বোধহয় এসব বাস্তবতারও প্রয়োজন আছে। আছে বলেই বিধাতা এর অবতারণা করান। এসব ভিন্নকিছু ঘটনা ঘটে বলেই আমাদের মনকে নাড়া দেয়। আমাদের সমাজে এমন অনেক হৃদয়বান মানুষ আছেন যাদের জন্য মানুষ অনেক নিরাপদ। আবার এমনও আছেন যারা বৃদ্ধ বাবা-মাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিতেও কার্পণ্য করে না।

সমাজে সাদা-কালো বা ভালো-মন্দের অবস্থান থাকবে। থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা বিবেকতাড়িত মানুষরা সাদার পক্ষে, মন্দের পক্ষে কখনো নই। আমাদের প্রত্যাশা, সমাজে সেই সুবাস বয়ে যাক, প্রতিটি হৃদয় আন্দোলিত হোক মানবিকতায়। যেখানে মা তার সন্তানকে আর কখনোই ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করবেন না। তেমন কোনো মেয়ে বা ছেলে তাদের বাবা-মাকে ঘর থেকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলবে না। নান্দনিক হবে আমাদের সমাজজীবন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close