গাজী শাহনেওয়াজ

  ০১ আগস্ট, ২০২১

প্রতিদিনের সংবাদকে ডা. বে-নজির আহমেদ

রপ্তানিমুখী শিল্প খুললে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়বে

চলমান কঠোর বিধিনিষেধ নানাভাবে অকার্যকর হয়েছে বলে মনে করেন দেশের একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তার অভিমত, কঠোর লকডাউন উপেক্ষা করে মানুষ ঘর থেকে বের হয়েছে। সর্বশেষ ১৪ দিনের লকডাউন শেষ না হওয়ার মধ্যে ৭ থেকে ৮ দিনের মাথায় এসে রপ্তানিমুখী শিল্প খুলে দেওয়ার মধ্যে এটার আর কোনো কার্যকারিতা থাকেনি। তিনি আরো বলেন, আমরা দেখছি কঠোর বিধিনিষেধও সংক্রমণ খুব একটা কমেনি। যার মানে বিধিনিষেধের ফল আমরা কাক্সিক্ষতভাবে পাইনি। তাই সংক্রমণ যদি বাড়ে তাহলে এটা নিয়ন্ত্রণে রাখা আরো কঠিন হবে। মানুষের মৃত্যু বাড়বে।

বিধিনিষেধের সুফল পাওয়ার ব্যাপারে গতকাল শনিবার প্রতিদিনের সংবাদকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ এসব কথা জানান।

ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, বর্তমানে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) যে পরিস্থিতি তা উদ্বেগজনক। গত ঈদুল ফিতরের পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে সংক্রমণ শুরু হয়েছিল তা এখনো কমেনি। এরপর বাকি সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে দেখা গিয়েছিল তা ক্রমান্বয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা দেশে সংক্রমণের উচ্চহার তা-ও বজায় আছে একটানা। তিনি বলেন, সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে লকডাউন দিলেও ঈদুল আজহার আগে গত ১৫ জুলাই সব খুলে দিয়ে লকডাউন উঠিয়ে নেওয়া হলো। তখনো সংক্রমণ কমেনি।

যার মধ্যে ৪ থেকে ৫টি বড় ঘটনা ঘটে; তার মধ্যে একটি দোকানপাট খোলায় শহরসহ সারা দেশে ব্যাপক লোকজন চলাচল শুরু করেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে কোরবানি উপলক্ষে দেশজুড়ে লাখের ওপরে পশুর হাট বসে এবং সেখানে কোটি কোটি মানুষ আসা-যাওয়া ও মেলামেশা করেছে। এখানে যেসব পশু বিক্রেতা আসে তাদের সবাই গ্রাম থেকে এসেছে; অনেক গ্রামেই সংক্রমণ ছিল।

সুতরাং পশু বিক্রেতারাও সংক্রমণ নিয়ে এসেছে। আবার যারা কিনতে গিয়েছিল তাদের কেউ কেউ এটা নীরবে বহন করে নিয়ে গেছেন। এটা করোনা বৃদ্ধির জন্য একটা বড় ঘটনা। আর তৃতীয় ঘটনা হচ্ছে ঈদ উৎসব উপলক্ষে বাড়িতে যাওয়া; এই সংখ্যা কোটির বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক বলেন, ঈদ আগে পরে যারা গ্রামে গেছেন যেখানে সংক্রমণ ছিল না সেখানেও ঝুঁকি ছড়িয়েছে। আবার বেড়ানো শেষে ফিরবেন তারাও সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে ফিরবেন। আর গার্মেন্টে কাজ করেন কোটির ওপরে মানুষ এটা খুলে দেওয়ায় কাজের প্রয়োজনে তাদের কর্মস্থলে ফিরবেন সেখানেও ঝুঁকি রয়েছে। কারণ গ্রামগঞ্জে সর্বত্রই করোনা সংক্রমিত। এখন যে সমস্যাটা দেখা দেবে ওখান থেকেও সংক্রমণ নিয়ে আসবেন। আবার ঢাকায় যখন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসবে তারা একত্রে মিশবে একজনের থেকে অন্যজনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াবে। বর্তমানে হাসপাতাল করোনা রোগীতে পরিপূর্ণ। কারণ আমাদের পরামর্শক কমিটির সদস্যরা বলেছিল লকডাউন আরো দীর্ঘায়িত হোক। আর স্বাস্থ্যের ডিজি বললেন, বিধিনিষেধ শিথিল করলে মহাসমস্যা দেখা দেবে। ওনারা তো পরিস্থিতি খারাপ ও প্রতি মুহূর্তে সমস্যা মোকাবিলা করছেন বলেই এসব আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। ওনারা তো এমনিই বলেননি; বাস্তবতার নিরিখেই বলেছেন। তাই যদি হয় সরকার এর বিপরীতে গিয়ে কলকারখানা খুলে দেওয়া হলো তাতে সংক্রমণের ঝুঁকিটা আরো বেড়ে গেল। এই অবস্থায় স্বাস্থ্য বিভাগ চিকিৎসাসহ করোনা মোকাবিলায় যে হিমশিম খাচ্ছে, সংক্রমণ যদি বেড়ে যায় তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, করোনা সংক্রমণ শুধু শহরে না গ্রামেও হচ্ছে। দেখা যায়, সেখানে অনেক নিম্নবিত্ত মানুষ থাকে তাদের অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে এই করোনায় অসুস্থতার কারণে।

বিধিনিষেধের মধ্যে রপ্তানিমুখী সব শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি খুবই হতাশাজনক এবং অনেকটা আত্মঘাতী। করোনা যখন উচ্চহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গার্মেন্ট খুলে দেওয়াই ৫০ থেকে ৬০ লাখ লোক একত্রে সমবেত হবেন। এসব শ্রমিক পোশাক কারখানার ভেতরে থাকেন না; সবাই থাকেন লোকালয়ে, তারা আসবেন যাবেন। পাশাপাশি একটি কর্মস্থলে বিভিন্ন এলাকার মানুষ কাজ করেন। তাদের মধ্যে যাদের শরীরে সংক্রমণ আছে এ নিয়েই তারা কাজ করবে। কারণ কাজ না করলে মজুরি পাবে না। এ অবস্থায় কারখানা খুলে দেওয়া আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে মনে করি ঠিক হয়নি।

শুধু বলব সামনে কী দাঁড়ায় ও কত লোক আক্রান্ত হয় এবং তাদের হাসপাতালে বেড পাওয়া, আইসিইউ পাওয়া ও অক্সিজেন কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেবেন তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

তিনি বলেন, যদি রোগীর চাপ আরো বাড়ে এতে কোনো কারণে একটি হাসপাতালের কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কত মানুষের প্রাণ হারাবেন অঙ্ক করে হিসাব মেলানো কঠিন। সব মিলিয়ে আমরা একটা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে আছি। বরং এখন আমাদের দরকার প্রতিটি রোগীকে আইসোলেট করা যাতে রোগটি না ছড়ায়। পাশাপাশি লকডাউনটা সবাই মিলে সচল করা। আমরা নিজেরা কেউ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হব না। দোকানপাট খুলব না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং শতভাগ মাস্ক পরা নিশ্চিত করা।

বে-নজির আহমেদ বলেন, সরকার যখন গার্মেন্ট খুলে দিলেন অন্যরাও দাবি তুলবেন তাদের প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য। সব মিলিয়ে আমার মনে হচ্ছে সিদ্ধান্তটা এই সময়ে আমাদের অনুকূলে যাবে বিশ্লেষণ ছাড়া বলা মুশকিল।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত করোনা নিয়ন্ত্রণে ১৪ দিনের লকডাউন কিন্তু সরকার কারখানা খুলে দেওয়ার ফলে তার যে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তা ব্যাহত হলো কি না জানতে চাইলে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, আমাদের ১৪ দিনের লকডাউন দু-তিনভাবে অকার্যকর হয়েছে। কারণ সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনেও অকারণে ঘর থেকে বের হচ্ছে মানুষ। শহরগুলোতে দেখেছি হাজার হাজার মানুষের সরব উপস্থিতি; যার ফলে লকডাউন সফল হয়নি। লকডাউনের মাত্র ৭ থেকে ৮ দিনের মধ্যে আবার গার্মেন্ট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো এর ফলে এটাও কার্যকর হলো না। পাশাপাশি নানাভাবে অ্যাফেক্ট পড়বে অর্থনীতি, সামাজিক ও শিক্ষাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে। আমার মনে হয় লকডাউনটা ভালোভাবে বাস্তবায়ন করা। আমাদের সবার মানা উচিত। কারণ ছাড়া বাইরে না যাওয়া। যাতে করে নিজেরা আক্রান্ত না হই এবং সংক্রমণটা বাইরে ছড়িয়ে না পড়ে। পাশাপাশি যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের আইসোলেশনের ব্যবস্থা নেওয়া।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close