বদরুল আলম মজুমদার

  ২৯ জুলাই, ২০২১

ইভ্যালিকে চিঠি দেবে সরকার জবাবের পর ব্যবস্থা

বন্ধের পথে বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালিকে কঠোর নজরদারির মধ্যে রেখে আবার সুযোগ দিতে চায় সরকার। আর্থিক অনিয়মসহ গ্রাহক থেকে পণ্যের অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য দিতে না পারার কারণে এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বিকাশের মতো ই-মানি লেনদেন করা প্রতিষ্ঠানও ইভ্যালির সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে দেয়। এদিকে শিগগিরই ইভ্যালির বিজনেস মডেল চেয়ে আত্মসমর্থনের চিঠি দেবে সরকার। ওই চিঠির জবাব সন্তোষজনক না হলে ইভ্যালির লাইসেন্স বাতিলসহ বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এর আগে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডের মাধ্যমে কেনাকাটা-সংক্রান্ত চুক্তি বাতিল করে ব্র্যাক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক, মূলত গ্রাহকের স্বার্থের ভেবে একইভাবে ওইসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের কার্ড ব্যবহারও স্থগিত করে। ক্রমাগত নেতিবাচক প্রচারণার কারণে সাধারণ গ্রাহকও মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকেন ইভ্যালি থেকে। সর্বশেষ দেশের বড় একটি শিল্প গ্রুপ এ প্রতিষ্ঠানটিতে পর্যায়ক্রমে এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের ষোষণা দেয়।

ইভ্যালির বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘ইভ্যালির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা কেন নেওয়া হবে না, তা জানতে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছি আমরা। এই নোটিসে বেশ কয়েকটি প্রশ্নের জবাবও চাওয়া হয়েছে। ইভ্যালি এখনো সে ব্যাপারে কোনো ব্যাখা দেয়নি মন্ত্রণালয়ে। আর ইভ্যালি কী চায় সে ধরনের কোনো পরিকল্পনার প্রস্তাব পেলে প্রয়োজনে তাদের কর্তাব্যক্তিদের ডাকা হবে। ইভ্যালির বিজনেস পরিকল্পনা সম্পর্কে জানব। তা যদি আইনসিদ্ধ হয় এবং এতে যদি ভোক্তার পাওনা পাই টু পাই পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে, তাহলে সরকার ভোক্তার স্বার্থে ইভ্যালির ব্যবসা সচল রেখে পাওনা পরিশোধের উদ্যোগে যাবে। তবে সবকিছু কঠোর নজরদারির মধ্যে রেখে করবে সরকার।’

বহুল আলোচিত ই-কমার্স সাইট ইভ্যালির কাছে বিপুলসংখ্যক গ্রাহক ও মার্চেন্টের পাওনা পরিশোধের পথ খুলতে যাচ্ছে। স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কর্মকা-ে ফিরতে প্রতিষ্ঠানটিকে কিছুটা সময় দেওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করছে সরকার। সেই সঙ্গে ইভ্যালিতে যমুনা গ্রুপের বিনিয়োগের তথ্যও এসেছে সংবাদমাধ্যমে। সম্প্রতি ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল ফেসবুক লাইভে এসে সংকট কাটাতে ছয় মাসের সময় চান। এ সময়ের মধ্যে সব গ্রাহকের পাওনা পরিশোধের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। দেশের শীর্ষ আইনজীবীরাও ভোক্তা সুরক্ষার স্বার্থে ইতিবাচক মত দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলছে, আনুষ্ঠানিক লিখিত প্রস্তাব পেলে ডাকা হতে পারে রাসেলকে। চাওয়া হতে পারে টেকসই বিজনেস প্ল্যান। কঠোর মনিটরিংয়ে রেখে তাকে একটি সময়ও দেওয়া হতে পারে।

ইভ্যালির কাছে বর্তমানে আটকে আছে গ্রাহকের অগ্রিম ও মার্চেন্টদের বকেয়া ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে থাকা ৬৫ কোটি টাকা দিয়ে ১৬.২২ শতাংশ গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব। বাকি পাওনা নিয়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। এ পরিস্থিতিতে গত ২৪ জুলাই রাতে ফেসবুক লাইভে আসেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেল। তিনি দাবি করেন, ঘাটতি থাকা ওই টাকা তারা ইভ্যালির ব্যবসার ব্র্যান্ডিংয়ে খরচ করেছেন। তাদের ব্যবসার ব্র্যান্ডিং পলিসি হচ্ছে, ভোক্তাকে অস্বাভাবিক কমমূল্যে পণ্য দিয়ে বেশি ক্রেতা আকৃষ্ট করা।

তিনি বলেন, ‘এভাবে ইভ্যালিকে ব্র্যান্ডিং করতে বেশি দামের পণ্য অতি কম দামে দেওয়ার কারণে তাদের সাময়িক লোকসান হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত ই-কমার্স সাইটগুলো প্রথমে এভাবেই লোকসান দিয়েছে। পরে তারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ইভ্যালির ক্ষেত্রেও সেই লোকসানই হয়েছে। তবে এতে ইভ্যালির যে ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি হয়েছে, সেই ব্র্যান্ড ভ্যালুই ব্যবসায় দেওয়া লোকসান রিকভার করবে।’

রাসেলের এমন বক্তব্যের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘ব্যবসায় লোকসান হতে পারে। তা যেকোনো কারণেই হোক। কিন্তু সেটি যদি রিকভার করার সুযোগ থাকে, এতে যদি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক ও মার্চেন্টদের পাওনা ফেরতের নিশ্চয়তা মেলে, তাহলে অবশ্যই সরকারের উচিত ভোক্তা সুরক্ষার স্বার্থে তাকে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া।’

আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার মেজবাহুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইভ্যালির কাছে যেসব গ্রাহক ও মার্চেন্ট টাকা পান, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেই টাকা উদ্ধারের কোনো সম্ভাবনা নেই। এখন ধরুন এ বিষয়ে মামলা হলো। তাকে গ্রেপ্তার এবং জেল দেওয়া হলো। ইভ্যালির ব্যাংক হিসাব বা অন্যান্য সম্পদ জব্ধ করা হলো। আদালতও বলল ক্ষতিগ্রস্তের টাকা পুনরুদ্ধার করে তা পাওনাদারদের ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু যে পরিমাণ টাকা গ্রাহক ও মার্চেন্ট পান বলে তথ্য রয়েছে, ইভ্যালি কর্তৃপক্ষের কাছে তো ওই পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ থাকতে হবে। না থাকলে ওই পাওনা পরিশোধের দায় তো সরকার নেবে না। নেওয়া উচিতও না। কারণ এখানে দুই পক্ষ ইভ্যালি ও ভোক্তা লেনদেন করেছে। পাওনা পরিশোধের দায়িত্ব ইভ্যালির ওপরই বর্তায়। সেখানে কর্তৃপক্ষের নগদ অর্থ, সম্পদ না থাকলে কোথা থেকে কী হবে। অর্থাৎ গ্রাহক ও মার্চেন্টদের পাওনা অপরিশোধই থেকে যাবে।’

সংকট কাটানোর উপায় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘উপায় একটাই হতে পারে গ্রাহকের পাওনা ফিরিয়ে দেওয়ার স্বার্থে ইভ্যালিকে বাঁচিয়ে রেখে বা ব্যবসা করতে দিয়ে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া। সেখানে কঠোর মনিটরিং বজায় রাখতে হবে। প্রয়োজনে পাওনা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত সরকার মনোনীত কোনো বিশেষজ্ঞ টিমকে ইভ্যালির ম্যানেজমেন্ট কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। তবে এর সবকিছুই নির্ভর করছে এ ঘটনার পর গ্রাহক বা ভোক্তা কতটা আস্থা রাখে তার ওপর।’

এদিকে, বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের কিন্তু আইনের মধ্যেই কাজ করতে হবে। কোনো ব্যক্তি যদি প্রতারিত হন তিনি মামলা করতে পারেন। তখন আদালত নির্ধারণ করে দেবে, তার যে ক্ষতি হয়েছে সেটা কীভাবে পূরণ করা হবে। ইভ্যালির ক্ষেত্রেও আমার মনে হয়, আদালতের মাধ্যমেই একটি নির্দেশনা আসতে হবে, ভোক্তাদের পাওনা অর্থ কোথা থেকে কীভাবে উদ্ধার করা যায় সে বিষয়ে।’

বাণিজ্যসচিব আরো বলেন, ‘পেইডআপ ক্যাপিটালের সঙ্গে অ্যাসেটের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এসেছে তার ৬৫ কোটি টাকার সম্পদ তদন্তে পাওয়া গেছে। এর বাইরেও তার সম্পদ আছে কি না, সেটি আমরা এখনো জানি না। এর বাইরেও সম্পদ থাকতে পারে। এ বিষয়টির অধিকতর তদন্ত চলছে। আমার মনে হয় সেই তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ জানার পরেই ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শিগগিরই আমরা ইভ্যালিসহ অভিযুক্ত আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের বিজনেস মডেল চেয়ে চিঠি দেব। ওই চিঠির জবাব সন্তোষজনক না হলে এবং প্রচলিত বিজনেস মডেল যদি বাংলাদেশে আইনসিদ্ধ না হয়, তাহলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলসহ বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

যমুনা গ্রুপ থেকে বিনিয়োগ পাওয়ার ঘোষণা : চলমান সংকটের মধ্যেই ইভ্যালিতে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ যমুনা গ্রুপের ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা এসেছে। প্রাথমিকভাবে ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে যমুনা। এরপর বিভিন্ন পর্যায়ে বিনিয়োগ করা হবে এক হাজার কোটি টাকা। গত মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইভ্যালির পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়। যমুনা গ্রুপ থেকেও তথ্যটি নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির মূল বাজারদর (ভ্যালুয়েশন) প্রকাশ করেনি কোনো পক্ষই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close