গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৮ জুন, ২০২১

দেশি টিকার সুখবর এ বছরই

দেশে নভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার আবারও ঊর্ধ্বমুখী। পাশাপাশি টিকা সংকটে কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধ কার্যক্রম কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত। ঠিক সেই সময়ে সুখবর দিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি)। তারা দেশীয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের উৎপাদিত বঙ্গভ্যাক্স মানবদেহে পরীক্ষার (হিউম্যান ট্রায়াল) অনুমোদন দিতে যাচ্ছে। ফলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে উৎপাদিত বঙ্গভ্যাক্সের টিকার সফল প্রয়োগের সুখবর চলতি বছরেই আসতে পারে। যা বাংলাদেশকে কোভিড মোকাবিলায় একধাপ এগিয়ে রাখবে বলে মনে করেছেন জনস্বাস্থ্য গবেষকরা।

দেশীয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের উৎপাদিত বঙ্গভ্যাক্স ছাড়াও চীন ও ভারতের দুটি টিকাসহ তিনটি টিকা মানবদেহে পরীক্ষার (হিউম্যান ট্রায়াল) জন্য শর্তারোপ করা হয়েছে। টিকাগুলোর পরীক্ষামূলক প্রয়োগের নীতিগত অনুমোদন দেওয়ার আগে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) গত বুধবার এই শর্তারোপ করে। এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে বিএমআরসির পরিচালক অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘বঙ্গভ্যাক্স টিকা কত দিনে পারব সেটা বলা যাচ্ছে না এখনই। কারণ দুটি সংস্থার মধ্যে সমঝোতার বিষয়। বঙ্গভ্যাক্সসহ এই টিকা উৎপাদনের সঙ্গে যারা জড়িত সবার সমন্বিত পদক্ষেপে এটা বাজারজাত হবে।’

ডা. রুহুল আমিন আরো বলেন, ‘টিকা উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ বিষয়টি গোপনীয়। সব প্রকাশ্যে বলা সমীচীন হবে না। তবে মানবদেহে প্রয়োগের ক্ষেত্রে কী ধরনের উপাদান সংমিশ্রণ করা হবে সেটা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো জানিয়ে দেওয়া হবে; আমাদের চাহিদা ও চাওয়া অনুযায়ী তারা কাজটি করে দেবেন। আমরা তখনই আশাবাদী হব যখন সবকিছুই ওকে হয়ে আসবে। তবে আশা করছি দেশবাসী চলতি বছরের মধ্যে সুখবরটি পেয়ে যেতে পারেন।’

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘বঙ্গভ্যাক্স টিকা দেশেই উৎপাদনের জন্য প্রাণিকুলের ওপরে একটি পরীক্ষা হয়েছে। সেগুলো ছিল পরীক্ষামূলক পরীক্ষা। হিউম্যান ট্রায়ালের আগে তখন তারা অনেক সংশোধন দিয়েছিলেন। প্রস্তাবে একশর বেশি সংশোধনী ছিল। এ সংক্রান্ত কমিটি সংশোধনীগুলো নিয়ে সভা করে সিদ্ধান্ত দিলে মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগে যেতে পারবেন।’

ঢাকা মেডিকেলের সাবেক এই অধ্যাপক আরো বলেন, ‘মানব দেহে পরীক্ষামূলক টিকা প্রয়োগের অনেক পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে ফেজ-১, ফেজ-২, ফেজ-৩ এবং ফেজ-৪ সবার শেষে। প্রথমে মানব জাতির কাছাকাছি যেসব প্রাণী আছে তাদের শরীরে টিকা প্রয়োগের কার্যক্রম শুরু করতে পারবে। মানবকুলের কাছাকাছি প্রাণী যেমন- বানর ও শিম্পাঞ্জির ওপরে ট্রায়াল চালানো। প্রথম দুটি ধাপ উত্তরণ ঘটাতে পারলে তখন তৃতীয় ফেজে যেতে পারবেন; তখনই স্পষ্ট হবে দেশীয় উৎপাদিত এই টিকার বাস্তবতা কেমন।’

বিএমআরসির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘যেকোনো ভ্যাকসিন হিউম্যান ট্রায়ালের আগে অ্যানিম্যাল ট্রায়াল হতে হবে। অ্যানিমেল ট্রায়ালের উচ্চতর প্রাণিকুল (হাইয়ার অ্যানিমেল) হতে হয়। এক্ষেত্রে বানর ও শিম্পাঞ্জির মতো প্রাণিকুলের দেহে যেকোনো ভ্যাকসিন ট্রায়াল দেওয়া ছাড়া মানবদেহে প্রয়োগের সুযোগ নেই। তবে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমি দায়িত্বে থাকা পর্যন্ত এ ট্রায়াল হয়নি। বর্তমানে এ ধরনের ট্রায়াল হয়েছে কি না আমার জানা নেই। তবে গত বুধবার বিএমআরসি দেশীয় প্রতিষ্ঠান বয়োটেক গ্লোবকে শর্তারোপ করে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দিতে যাচ্ছে যা ইতিবাচক।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘আইইডিসিআরের পাশাপাশি অন্যান্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তাদের কাজে লাগালে পরিধি বাড়বে। পরে সরকার টিকাদান করতে চাইলে তখন কাজে লাগবে।’

এদিকে, বুধবার বিএমআরসির বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত ইথিক্যাল বোর্ডের এক সভা থেকে দেশেই টিকা উৎপাদনের খবরটি জানানো হয়। বিএমআরসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিউম্যান ট্রায়ালের আগে বিএমআরসির নিয়ম অনুযায়ী সব ধরনের শর্ত পূরণ করতে হবে। এজন্য নির্দেশনা দিয়ে আগামী রবিবার তিনটি প্রতিষ্ঠানকেই চিঠি দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে বিএমআরসির পরিচালক অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন বলেন, ‘তিনটি কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে হিউম্যান ট্রায়ালের আগে শিম্পাঞ্জি ও বানরের ওপর টিকাগুলোর কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সব কাগজপত্র বিএমআরসিতে জমা দিতে হবে।’

এর আগে গত ১৭ জানুয়ারি এই টিকার ট্রায়ালের জন্য নৈতিক ছাড়পত্র পেতে ১০ হাজার পৃষ্ঠার প্রটোকল পেপার বিএমআরসির কাছে জমা দেয় গ্লোব বায়োটেকের পক্ষে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান। তার আগে ২৮ ডিসেম্বর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অংশ হিসেবে টিকা উৎপাদনে ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি পায় বঙ্গভ্যাক্স। বঙ্গভ্যাক্সের পাশপাশি আরো দুটি টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্য দুটি টিকা হলো ভারত বায়োটেকের কোভ্যাকসিন ও চীনের সিনোভ্যাকের করোনাভ্যাক।

এদিকে, বাংলাদেশে বেশ কিছু দিন থেকে করোনাভাইরাসের টিকার ট্রায়াল নিয়ে আলোচনা হলেও এত দিন অনুমোদন দেওয়া হয়নি। বিএমআরসির সিদ্ধান্ত বিলম্বিত হওয়ায় চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের একটি অংশের মধ্যে হতাশা ছিল। তবে প্রতিষ্ঠানটির বুধবারের সভার সিদ্ধান্ত জানানোর পর দেশীয় টিকা প্রয়োগের সম্ভাবনা এক ধাপ এগিয়ে গেল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close