গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৮ মে, ২০২১

অর্থনীতিবিদদের অভিমত

কোভিডে বাড়ছে কর্মহীন মানুষ

শ্রমজীবীদের কাজের সুযোগ দেওয়া জরুরি

নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড) সংক্রমণ রোধে কয়েক দফায় বিধিনিষেধ বাড়িয়ে আগামী ২৩ মে পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে সরকার। এর ফলে দেশে কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এরমধ্যে গ্রামের তুলনায় শহরে দারিদ্র্য মানুষের সংখ্যা বেশি বাড়ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি শ্রমজীবী মানুষের কাজের সুযোগ দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্যানুযায়ী, কোভিডের কারণে দেশে প্রতি চারজন যুবকের একজন বেকার হয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে চাকরি করেন এমন ১৩ ভাগ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। বেতন কমেছে ২৫ ভাগ মানুষের।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আড়াই কোটি। বর্তমান পরিস্থিতিতে সংখ্যা বাড়লেও তাদের কাছে এ মুহূর্তে কোনো পরিসংখ্যান নেই। আর বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির হিসাব অনুযায়ী, কোভিডের কারণে কাজ হারিয়ে গত এক বছরে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে।

কোভিড পরিস্থিতিতে কাজ হারিয়ে অনেকেই মানবিক জীবনযাপন করছেন। তাদেরই একজন ফরিদপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ শহীদ। তিনি রাজধানীর মিরপুরে মুটের কাজ করেন। কোভিড সংক্রমণের কারণে কাজকর্ম তেমন পান না আগের মতো। ফলে সংসার খরচ চালানোই এখন কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর মিরপুরের বিহারী ক্যাম্পের বাসিন্দা দিল্লু ওয়াসা ও বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ড্রেনেজ ও সুয়ারেজ লাইন পরিচ্ছন্নের কাজ করে জীবনধারণ করেন। তবে কোভিডের ধাক্কায় তার সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। কর্মহীন হয়ে পড়া দিল্লু অন্যের বাড়িতে এখন পানি সরবরাহ করে কোনো রকমে দিন পার করছেন বলে জানান।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই সংকটে স্বল্প আয়ের কর্মহীন শ্রমজীবীদের সামান্য কিছু টাকা দিলেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। বিশেষ করে কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষ যাতে অতি-দরিদ্রের কাতার থেকে বের হয়ে আসতে পারে এ পথ সুগম করতে হবে।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ এ প্রসঙ্গে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘করোনার থাবায় শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন পড়ায় আমি লকডাউনের বিপক্ষে। কারণ সরকারের কোনো অনুদান ওই শ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছাবে না। আর লকডাউন মানে দেশের অর্থনীতিকে লকডাউন করে রাখা।’

অধ্যাপক আবু আহমেদ আরো বলেন, ‘শ্রমজীবী মানুষ যদি কাজ করতে না পারেন, তাহলে ওরা খাবে কীভাবে ও চলবে কীভাবে? সমাজের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ এই শ্রেণির মানুষ। করোনার অজুহাতে যদি তাদের কাজ থেকে দূরে রাখা হয়, তাহলে অনুদান দিয়ে তাদের রক্ষা করা যাবে না। শ্রমজীবী মানুষ জীবিকার তাগিদে কাজের প্রয়োজনে বাইরে চলে আসে; এটাই তো স্বাভাবিক। যারা লকডাউনের পক্ষে, তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করতে চাই সমাজের এই ৩৫ শতাংশ লোকের কর্মসংস্থান কীভাবে হবে? এরই মধ্যে শহরকেন্দ্রিক দারিদ্র্য বেড়েছে।’

এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘শ্রমজীবী মানুষকে বাঁচাতে চাইলে লকডাউনের বিকল্প চিন্তা করতে হবে সরকারকে। আমাদের অর্থনীতি যদি ঠিক না থাকে এবং ওরা যদি কাজে না থাকে; তাহলে না খেয়ে মরবে। তারা হঠাৎ মরবে না আস্তে আস্তে মরবে। আর সবকিছু খোলা রেখে লকডাউন দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের প্রতি অবিচার করা হয়েছে।’

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপরে যখন চরম চাপ পড়ে এবং এটা যখন হ্যান্ডেলিং করা সম্ভব হয় না; তখন চরম ব্যবস্থা হিসেবে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এটা সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ হতে পারে। এ সময়ে শ্রমজীবী মানুষের কাছে আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে; যা সরকারের জন্য কঠিন কোনো কাজ বলে আমার মনে হয় না। তবে আমাদের এখানে সেটা সম্ভব হয় না। এ কারণে গণপরিবহন বন্ধ রাখার পরও সড়কে যানজট তৈরি হয়। অপরদিকে লম্বা সময় লকডাউন থাকার কারণে শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন থাকছে।’

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন আরো বলেন, ‘লকডাউনের বিকল্প চিন্তা করা সরকারের কাছে সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। কারণ লকডাউনে সর্বনাশ হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের। কেননা মানুষের কষ্টের কথা ভেবে কিছু ছাড় দিয়ে শপিং মল ও দোকানপাট খুলে দেওয়া হচ্ছে। সময়ে সময়ে এই সিদ্ধান্তের কারণে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে কাজের চাহিদা ফিরে আসে না। স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে মানুষজন যতটুকু কাজ করতে পারে; সে ব্যবস্থা করাই শ্রেয়। এতে শ্রমজীবী মানুষ না খেয়ে মরবে না; বেঁচে যাবে।’

এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘যারা দিনে আনে দিনে খায় তাদের কোনো সঞ্চয় নেই এবং আয়ের অন্য কোনো উপায়ও নেই। তাদের কাছে সহায়তা পৌঁছানোর একটা ব্যবস্থা করা উচিত। গত এক বছরে আমাদের কিছু শেখার কথা থাকলেও তা শিখতে পারিনি। অর্থনীতি পুরো সচল না হলে শ্রমজীবী মানুষের দুর্দিন চলতে থাকবে। ওদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের নেই। অন্যদিকে আমরা যখন মোটা অঙ্কের সহায়তা কর্মসূচি দেখি; তখন অর্থের জোগানে কোনো ঘাটতি দেখি না; এটাই দুঃখের বিষয়।’ তিনি বলেন, ‘দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আড়াই কোটি, সেখানে ছয়ত্রিশ লাখ সহায়তা পাচ্ছে; এটা তো দুঃখজনক। এতে নগরের দরিদ্ররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদের চিহ্নিত করা কঠিন কোনো কাজ না। শহরের বস্তি কোথায় আছে এবং শ্রমজীবী মানুষ কোথায় থাকে এসব সবার জানা। শ্রমজীবী মানুষের তাৎক্ষণিক সহায়তা দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close