নিজস্ব প্রতিবেদক
গ্লোবের টিকা পরীক্ষার অনুমোদন কত দূর
মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের নীতিগত অনুমোদন মেলেনি সাড়ে তিন মাসেও
দেশি কোম্পানি গ্লোব বায়োটেকের উদ্ভাবিত নভেল করোনাভাইরাসের টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের নীতিগত অনুমোদন মেলেনি সাড়ে তিন মাসেও। এজন্য গত জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলে (বিএমআরসি) আবেদন জমা দিয়েছিল গ্লোব। পরে বিএমআরসির চাহিদা অনুযায়ী তথ্য-উপাত্ত যোগ করে ফেব্রুয়ারিতে সংশোধিত আবেদন জমা দেওয়া হয়। ‘বঙ্গভ্যাক্স’ নামের এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের নীতিগত অনুমোদন পাবে কিনা, পেলেও কবে নাগাদ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে এসব প্রশ্নের স্পষ্ট কোনো উত্তর মেলেনি।
এ বিষয়ে বিএমআরসির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. রুহুল আমিন গত বুধবার একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এই ব্যাপারটা টোটালি আমাদের চেয়ারম্যান স্যার দেখছেন। এটার ব্যাপারে আমার তেমন কিছু বলার নেই।’ কিন্তু বিএমআরসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এ বিষয়ে গণমাধ্যমে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আই শ্যাল নট কমেন্ট অ্যানি মিডিয়া, অ্যানিহোয়্যার অ্যাবাউট দিস।’
আগামী জুলাইয়ের আগে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা পাওয়া অনিশ্চিত। ফলে বিকল্প উৎস থেকে টিকা আনার উদ্যোগ নেয় সরকার। এজন্য চীন ও রাশিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বৃত্ত টিকা সংগ্রহ করার চেষ্টাও চলছে। এ প্রেক্ষাপটে নতুন করে আবার আলোচনায় এসেছে দেশি ওষুধ প্রস্তুতকারক গ্লোব ফার্মার সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের উদ্ভাবন করা কোভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকা বঙ্গভ্যাক্স।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সব প্রস্তুতি থাকলেও বিএমআরসির ইথিক্যাল কমিটির ছাড়পত্র না পাওয়ায় ট্রায়াল শুরু করা যাচ্ছে না। ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিআরও) লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি গ্লোব বায়োটেকের হয়ে টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কাজটি করবে। এই ট্রায়াল হবে একটি সরকারি হাসপাতালের একটি ইউনিটে। গ্লোব বায়োটেকের হয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনাকারী দলের নেতৃত্ব দেবেন অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘বিএমআরসির ইথিক্যাল কমিটি আমাদের আবেদনটি গ্রহণ করেছে। পরবর্তী সময়ে তারা প্রায় ১০০টি বিষয়ে প্রশ্ন করেছিল সেগুলোর সন্তোষজনক উত্তর আমরা লিখিতভাবে দিয়েছি। কিন্তু তারা পরে আর কিছু জানায়নি।
গ্লোব বায়োটেকের ব্যবস্থাপক (কোয়ালিটি অ্যান্ড রেগুলেটরি অপারেশনস) ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘বিএমআরসিতে আবেদন জমার চার মাস পার হলেও আমরা কোনো অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না। এর মধ্যে তাদের কিছু প্রশ্ন ছিল যেগুলোর জবাব আমরা দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘ইথিক্যাল কমিটির কাছে মূলত ফেজ-১ ও ফেজ-২ এর ট্রায়ালের জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। তারা ছাড়পত্র না দেওয়ায় ট্রায়াল শুরু করা যাচ্ছে না। বিএমআরসি ছাড়পত্র না দিলেও গ্লোব বায়োটেককে ট্রায়ালের জন্য ভ্যাকসিন উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর এ অনুমোদন দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে ড. মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের যদি ভ্যাকসিন উৎপাদনের সক্ষমতা না থাকত তাহলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এ ছাড়পত্র দিত না। তারপরও আমাদের যদি কোনো ঘাটতি থেকে থাকে সেটা বিএমআরসি আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে জানাতে পারে। কিন্তু আমাদের এ সম্পর্কে কিছুই অবগত করা হচ্ছে না।’
গ্লোব বায়োটেক জানিয়েছে, ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশন লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টিকার ফেজ-১ ও ফেজ-২ এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রটোকল নীতিগত অনুমোদনের জন্য ১৭ জানুয়ারি বিএমআরসিতে দেওয়া হয়। বেশকিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ৯ ফেব্রুয়ারি গ্লোব বায়োটেককে একটি চিঠি দেয় বিএমআরসি। ওই চাহিদা অনুযায়ী সংশোধিত প্রটোকল ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ১৭ ফেব্রুয়ারি আবার জমা দেওয়া হয়।
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জানান, তাদের টিকার একটি ডোজের ‘অ্যানিমেল ট্রায়ালে’ কার্যকর অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেও একই ধরনের ফল পাওয়া যাবে বলে তাদের বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘নীতিগত অনুমোদন দেওয়ায় পুরো প্রক্রিয়াটি এখনো বিএমআরসিতে আটকে আছে। এখান থেকে অনুমোদন পেলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আমরা প্রটোকল জমা দেব। সেখান থেকে অনুমোদন পেলে আমরা মানুষের শরীরে এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করতে পারব।’
মহিউদ্দিন জানান, এই টিকা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১ মাস এবং মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে।
দেশে নভেল করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর গত বছর ২ জুলাই গ্লোব বায়োটেক টিকা তৈরির কাজ শুরুর কথা জানায়। ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে এই টিকা বাজারে আনা যাবে বলেও আশা প্রকাশ করেছিলেন তারা। পরে গত বছর ৫ অক্টোবর গ্লোব বায়োটেক জানায়, ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করেও তাদের ওই সম্ভাব্য টিকা ‘কার্যকর ও সম্পূর্ণ নিরাপদ’ প্রমাণিত হয়েছে।
গ্লোব বায়োটেকের উদ্ভাবিত তিনটি সম্ভাব্য টিকা পরে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
ওই দিনই মহিউদ্দিন জানান, তাদের ওই তিনটি টিকার মধ্যে D614G variant mRNA vaccine- এর প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ হয়েছে।
শুরুতে গ্লোব বায়োটেক তাদের টিকার নাম দেয় ‘ব্যানকোভিড’। পরে তা পরিবর্তন করে ‘বঙ্গভ্যাক্স’ রাখা হয়।
গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডকে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের অনুমতি দেয়।
পরে ১৭ জানুয়ারি এই টিকা মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নীতিগত অনুমোদন চেয়ে আবেদন করে গ্লোব বায়োটেক।
"