জিয়াউদ্দিন রাজু

  ০৫ মে, ২০২১

পরিবহন শ্রমিকদের পাশে নেই ইউনিয়ন-মালিক

‘অনেক কষ্টে খাইয়া না খাইয়া বাঁইচা আছি। কারো কাছ থাইকা কোনো অনুদান, এমনকি ধারও পাই নাই। প্রায়ই শুধু চিড়া দিয়া ইফতার করতে অয়। কোনো রহম কিছু খাইয়াই রোজা রাহন লাগে। লকডাউন আরো বাড়লে কীভাবে চলব আল্লাহই ভালো জানে।’ বলছিলেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর-খিলগাঁওয়ে রুটে চলাচলকারী ‘বাহন’ পরিবহনের একটি বাসের সহকারী আবদুস সোবাহান।

একই বাসের চালক ইকবাল হোসেন বলেন, ‘লকডাউনে অনেক চিন্তার মইধ্যে দিন পার করতাছি। আমরা দিন আনি দিন খাই। আমাদের জমানো টাকা থাহে না। লকডাউন আরো বাড়লে কী খাইব, কী করব কিছুই মাথায় আইতাছে না।’

এমন কথা শুধু ‘বাহন’ পরিবহনের চালক বা সহকারীরই নয়, রাজধানীতে ৩০ হাজার পরিবহন শ্রমিকের। চার চাকার এ যানটি চললেই এদের সঙ্গে পেট চলে আরো ২০ হাজারের বেশি শ্রমিকের; যারা রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোয় সৌন্দর্যবর্ধন থেকে শুরু করে অনেক কাজের সঙ্গে যুক্ত। আছে তাদের পরিবার-পরিজনও। কিন্তু প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় এদের জীবিকার চাকা থমকে যেতে বসেছে। গত বছরের দীর্ঘ ‘লকডাউন’ কোনো রকমে পার করে একটু ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু হয়েছিল এদের। কিন্তু কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে পড়েছেন মহাবিপদে। শ্রমিকদের অভিযোগ, এবার সরকারি সহায়তা খুব একটা পৌঁছায়নি পরিবহন শ্রমিকদের কাছে। আবার মালিকরাও তাদের তেমন কোনো সহায়তা করেননি। পাশে নেই শ্রমিক ইউনিয়নগুলোও। যদিও শ্রমিকদের কল্যাণের নামে ইউনিয়নগুলোর পক্ষ থেকে সারা বছর আদায় করা হয় বিপুল পরিমাণ চাঁদা।

দেশের প্রতিটি বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে ঘোষণা দিয়ে দিনে ৭০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। দেশে সব মিলিয়ে বাণিজ্যিক যানবাহন আছে ৮ লাখের বেশি। সে হিসাবে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় হয়। এর বাইরে অঘোষিত চাঁদার তো কোনো হিসাবই নেই। মালিক-শ্রমিকদের কল্যাণের কথা বলে এসব চাঁদা আদায় হলেও এখন নভেল করোনাভাইরাসের দুর্দিনে তাদের পাশে নেই কেউ।

গত বছর মে মাসে ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের ইউটিউব টকশোতে এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান বলেছিলেন, ফেডারেশনের কোনো কল্যাণ তহবিল নেই। ফেডারেশন কল্যাণ তহবিলের টাকা সংগ্রহ করে না। তিনি বলেন, ‘মূলত, টার্মিনালভিত্তিক বা যেসব এলাকায় শ্রমিক ইউনিয়ন কিংবা মালিক সমিতি আছে, তারা টাকা সংগ্রহ করে। আমি যতদূর জানি, মালিক সমিতি নিজস্ব শ্রমিকদের টাকা দিয়েছে। এমনকি শ্রমিক ইউনিয়নগুলোও গচ্ছিত তহবিল উজাড় করে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছে।’

গত কয়েক দিন রাজধানীতে বেশ কয়েকজন পরিবহন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার সরকারিভাবে আরোপ করা বিধিনিষেধকালে তারা মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন বা ফেডারেশন থেকে কোনো সহায়তা পাননি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের এক নেতা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘এত দিন যে শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করে মালিকদের ব্যবসা চলল, তারা তো আয় করেছে। এখন তাদের উচিত শ্রমিকদের দায়িত্ব নেওয়া। শ্রমিক ইউনিয়নগুলো বছর বছর যে চাঁদা তুলেছে সে অর্থ নিয়ে তাদের এগিয়ে আসা উচিত। সরকারেরও এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া দরকার ছিল, যাতে মালিক ও শ্রমিক নেতারা দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে না পারেন।’

গত মঙ্গলবার ভোরে ময়মনসিংহ থেকে রাজধানীতে আসেন বাসচালক শাহে আলম। ‘স্মার্ট উইনার’ পরিবহনের বাস চালান তিনি। আজিমপুর থেকে কুড়িল বিশ্ব রোডে চলে এই বাস। অভাবের সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী শাহে আলমের অন্য কাজ জানা না থাকায় একমাত্র ভরসা বাস চালানো। সেজন্যই তিনি কতটা পথ হেঁটে, কতটা তিন চাকার যানে করে রাজধানীতে আসেন। দীর্ঘদিন বাড়িতে থাকায় অভাব-অনটনে দিন কাটছিল শাহে আলমের। দুদিন আজিমপুরে কাটিয়েছেন তিনি। সরকারের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছেন তিনি। শাহে আলম বলেন, ‘বাস চল্লে পকেটে ট্যাহা আহে, আমাগো ইনকাম হয়। লকডাউনে বাস চলে না, আমাগো রোজগারও হয় না। আবার সামনে ঈদ, বউ, পোলা-মাইয়্যাগোরে কাপড় দিতে হইবো। বন্ধু কইছে বাস নাকি চালাইতে দিব। তাই আইলাম শহরে।’ তিনি জানান, এখন পর্যন্ত পরিবহন মালিক বা সমিতি থেকে কোনো সাহায্য পাননি। সন্তানদের জন্য নতুন জামা নিয়ে বাড়ি ফেরার স্বপ্ন শাহে আলমের মতো আরো অনেক বাস শ্রমিকের।

গাবতলীর বাস টার্মিনালে রাস্তায় ১১ বছর ধরে বাসের টিকিট বিক্রি করেন হাশেম। তিনি জানান, রমজানেও কোনো আয় হচ্ছে না। অথচ আগের বছরগুলোতে এ সময়ে দৈনিক আয় ছিল ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা।

এরই মধ্যে গণপরিবহন চালুসহ তিন দফা দাবিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ২৪৯টি পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন গত রবিবার বিক্ষোভ করে। ওইদিন সকাল থেকে রাজধানীর সায়েদাবাদ, ফুলবাড়িয়া, গাবতলী, মহাখালী বাস টার্মিনালে জড়ো হতে থাকেন পরিবহন শ্রমিকরা। তারা বিভিন্ন দাবি সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন হাতে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন।

পরিবহন শ্রমিকদের তিন দফা দাবির মধ্যে আছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আসনের অর্ধেক যাত্রী নিয়ে নৌপরিবহন ও পণ্য পরিবহন চলাচলের ব্যবস্থা করা, সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের আর্থিক অনুদান ও খাদ্য সহায়তা দেওয়া এবং সারা দেশে বাস ও ট্রাক টার্মিনালগুলোয় পরিবহন শ্রমিকদের জন্য ১০ টাকায় ওএমএসের চাল বিক্রির ব্যবস্থা করা।

পরিবহন শ্রমিকদের কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক ও পরিবহন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, গণপরিবহন চালুর বিষয়ে সরকার ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করছে। তবে গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন, আগামী ৬ মে থেকে জেলার অভ্যন্তরীণ রুটে গণপরিবহন চলবে। অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কিন্তু বাস কোনোভাবেই এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে পারবে না।

এ সিদ্ধান্তে খুশি নন গণপরিবহন মালিকরা। মহামারিতে নিজেদের আর্থিক লোকসান পুষিয়ে নিতে তারা দূরপাল্লার বাস চলাচলের অনুমতি চাচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকার দোকানপাট, শপিং মল সবই খুলে দিয়েছে। আমরা বাস চলাচলের অনুমতি চেয়ে সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছি। এখন ৬ মে থেকে শুধু সিটিতে চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। এতে কী হবে? সিটিতে কয়টা গাড়ি চলে? সব তো দূরপাল্লার বাস।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close