গাজী শাহনেওয়াজ ও সোহাগ আহম্মেদ

  ১৬ এপ্রিল, ২০২১

পাড়া-মহল্লায় সবই খোলা

ঢাকার রাস্তায় বেড়েছে রিকশা-অটোরিকশা

পল্লবীর কালশী এলাকার মুদি ব্যবসায়ী জব্বার গত দুদিন তার দোকান খোলা রাখেন আগের মতোই। সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ মানতে সাধারণ মানুষকে বাধ্য করবে কে, তা নিয়ে তার মধ্যে ছিল নানা সংশয়। তিনি বলেন, ‘শুনেছি লকডাউনে সবারই নাকি নানা সমস্যা হচ্ছে। আবার দেখছি সবাই বাইরে যাচ্ছে যার যার প্রয়োজনে। পাড়া-মহল্লায় এবং মুদি ও কাঁচাবাজারে ভিড় দেখে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করছেন কেউ কেউ।’ আজিমপুরের বাসিন্দা পলাশ কুন্ডু জানান, কাজের প্রয়োজনে সকালে বাসা থেকে বের হন তিনি। বিকালে বাসায় ফেরার আগে রাস্তায় কোথাও তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি। এ কারণে পকেটে থাকা মুভমেন্ট পাসটিও ব্যবহার করা হয়নি।

আরামবাগের বাসিন্দা কামরুন নাহার একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। তিনি বলেন, ‘বিকালে আমার স্বামী আরামসে গিয়া হালিম আর জিলাপি কিন্না বাসায় আনছে। তারে কেউ কিছুই বলে নাই। উল্টো পুলিশ যত্ন কইরা হালিমের লাইনে দাঁড় করাইয়া দিসে।’

নভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি থামাতে সরকার ‘সার্বিক কার্যাবলি বা চলাচলে’ নতুন করে যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে তার দ্বিতীয় দিনে রাস্তায় তুলনামূলক শিথিলভাব দেখা গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পুলিশ চেকপোস্টগুলো প্রথম দিনের চেয়ে দ্বিতীয় দিন কিছুটা নমনীয়। প্রথম দিন যেসব চেকপোস্টে পুলিশ বেশ কঠোর মনোভাব দেখিয়ে প্রায় প্রতিটি গাড়ি আটকে যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, গতকাল তেমনটা দেখা যায়নি। তবে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে সব রাস্তায় চলাচল করা যাচ্ছে না।

লকডাউন নামে পরিচিতি পাওয়া বিধিনিষেধের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখের ছুটি থাকায় সবকিছু বন্ধ ছিল। ফলে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়েছে কম। কিন্তু গতকাল ব্যাংক, শেয়ারবাজার, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান খোলা। ফলে সকাল থেকে রাস্তায় গাড়ির চলাচলও বেড়েছে কিছুটা।

সকাল ৭টা থেকে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পোশাকশ্রমিকদের দলে দলে কর্মস্থলে যেতে দেখা গেছে। পোশাকশ্রমিকরা যেহেতু কারখানার আশপাশের এলাকায় বসবাস করেন, সেজন্য তাদের পরিবহনের প্রয়োজন হয়নি।

সকাল পৌনে ৮টার দিকে রাজধানীর হোটেল র‌্যাডিসনের সামনে সড়কে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। সেই জট পৌঁছে যায় বিমানবন্দর সড়ক পর্যন্ত। র‌্যাডিসনের সামনে থাকা পুলিশ চেকপোস্টে প্রতিটি গাড়ি চেক করা হয়েছে। প্রতিটি গাড়ি থামিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে কে কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কোথা থেকে এসেছে। এভাবে করে গাড়ি চেক করতে গিয়ে রাজধানীর ব্যস্ততম এই সড়কে তৈরি হয়েছে বিশাল যানজট।

কারওয়ান বাজার এলাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী মাসুদ রায়হান বলেন, ‘ঢালাওভাবে বলব না, প্রধান সড়কগুলোতে আজও পুলিশ বেশ সতর্ক ছিল। রাস্তায় মানুষ দেখা গেছে কম।’ নাজমুল হাসান সাগর বলেন, ‘দুপুর ১২টার পরই সব কড়াকড়ি উঠে যায়।’

রামপুরা, মালিবাগ, বিজয়নগর, কাকরাইল ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে, গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও রাস্তায় রিকশা চলাচল বেড়েছে। কিছু সিএনজিচালিত অটোরিকশাও চলতে দেখা গেছে। বেড়েছে ব্যক্তিগত গাড়িও। তবে যানবাহন ও পথচারী চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে তৎপর ছিলেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। কয়েকটি স্থানে পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে রিকশা উল্টে রাখা এবং সিএনজি অটোরিকশা আটক করার দৃশ্য দেখা গেছে।

যাত্রাবাড়ী এলাকায় গণপরিবহন ও শপিং মল ছাড়া সব কিছু চালু ছিল। সকাল থেকে কাঁচাবাজার আর মাছবাজারে ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়। মাস্ক পরা মানুষের সংখ্যা ছিল কম। স্বাস্থ্যবিধির কিছুই মানতে দেখা যায়নি মানুষকে। নানা অজুহাতে, নানা উপায়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে মানুষ।

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, সব ধরনের বাস-মিনিবাস সারি সারি দাঁড় করানো। বাসশ্রমিকরা অলসভাবে বসেছিলেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার শাহ ইফতেখার আহম্মেদ প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, লকডাউনে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠে কঠোর ও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। তিনি আরো বলেন, ‘মাস্ক পরিধান ও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বাইরে চলাচল করতে দেওয়া হবে না। যদি কাউকে জরুরি প্রয়োজনে বের হতে হয়, তাহলে মুভমেন্ট পাস নিয়ে বের হতে হবে।’

কাকরাইলে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আজকে অনেক রিকশা নেমেছে। কী করবে বলুন? আমিও রামপুরার চৌধুরীপাড়া থেকে রিকশায় এসেছি। আসার পথে রিকশাচালককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন রিকশা বের করেছ? সে বলল, পাঁচজনের সংসার চালাতে তাকে প্রতিদিন রিকশা চালাতে হয়। নইলে তারা না খেয়ে থাকবে।’

সকাল সাড়ে ৯টায় কাকরাইল মোড় ও নাইটিঙ্গেল মোড়ে দেখা গেল কয়েকটি রিকশা উল্টে রাখা হয়েছে। সেখানে রিকশাচালক কালু মিয়া বলেন, ‘স্যার একটু কইয়া দেন পুলিশ ভাইকে আমার রিকশাটা ছাইড়া দিতে। পেটের খিদায় রাস্তায় নামছি। ভুল হইছে আমার, গলিতে থাকা ঠিক ছিল। একটা ক্ষেপ কাকরাইলে মারতে আইসা ধরা খাইছি। কত রিকশা চলছে, কপাল মন্দ আমি ধরা খাইলাম।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. নুরুজ্জামান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘সরকার একটি বৃহৎ ক্ষেত্র। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব না। কারণ সামগ্রিক অর্থনীতি ও কূটনীতিক পলিসি অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়। সেদিক থেকে লকডাউন না বলে করোনাকালীন দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে; এটা সামগ্রিক বিবেচনায় যৌক্তিক। তবে এই বিধিনিষেধের মধ্যেও মানুষের মধ্যে স্বাস্ব্যবিধি মানায় কোনো সচেতনতা দেখতে পারছি না। প্রতিদিন দেশে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু মানুষ নিজের সুস্থতার কথা ভেবে মুখে মাস্ক পরছে না, এটা দুংখজনক।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘প্রধান সড়কে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ কমবে, এমনটা তো নয়। কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ তো পাড়া-মহল্লায়ও থাকতে হবে। কিন্তু এখানে তো কোনো প্রশাসনের নজরদারির খবর পাচ্ছি না। যথারীতি হাট-বাজার, দোকানপাট খোলা আছে। গাদাগাদি করে মানুষ পন্য কিনছে। প্রধান সড়কের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় দোকানপাট বন্ধ রাখা সম্ভব না হলে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি হ্রাসে সরকারের নেওয়া এই পদক্ষেপও আগের শিথিল লকডাউনের মতো অকার্যকর হবে।’

দেশে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) বিস্তার রোধ করার লক্ষ্যে ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত আট দিনের জন্য ‘সার্বিক কার্যাবলি বা চলাচলে’ নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। গত সোমবার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ১৪ এপ্রিল থেকে দেশে ‘কঠোর লকডাউন’ দেওয়া হবে বলে কয়েক দিন ধরে দায়িত্বশীল মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা বলে এলেও প্রজ্ঞাপনে ‘লকডাউন’ শব্দটির উল্লেখ নেই। বরং ছাড় দেওয়া হয়েছে নানা ক্ষেত্রে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকারি, বেসরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট এ সময়ে পুরোপুরি বন্ধ থাকবে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা রাখা যাবে শিল্প-কারখানা। এ সময়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। তবে টিকা নেওয়ার প্রয়োজনে টিকার কার্ড দেখিয়ে বের হওয়া যাবে। এ ছাড়া ওষুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনা, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন বা সৎকার ইত্যাদি প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়া যাবে।

কয়েক দিন ধরেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল একটি ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ দেওয়ার কথা। বলা হচ্ছিল, কোনো শিল্প-কারখানা খোলা রাখা হবে না এবার। কিন্তু গত ১১ এপ্রিল পোশাকশিল্পের মালিক সংগঠনগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খোলা রাখার দাবি জানায়। সেই ধারাবাহিকতায় প্রজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে, এবারও ছাড় দেওয়া হলো শিল্প-কারখানাগুলোকে।

তবে সড়ক, নৌ, রেল, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট এবং সব ধরনের পরিবহন বন্ধ থাকবে। পণ্যবাহী যানবাহন ও জরুরি সেবার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ রাখা হয়নি।

গত মার্চে দেশে কোভিড সংক্রমণ বাড়তে থাকায় তখন থেকেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কমপক্ষে দুই সপ্তাহের জন্য ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ ও কারফিউ জারি করার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য পূর্ণাঙ্গ লকডাউন দেওয়ার সুপারিশ করেছিল কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও গত ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সুপারিশ করেছিল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close