মিজান রহমান

  ০১ মার্চ, ২০২১

কৃষি উৎপাদনে শীর্ষ দশে

কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে দেশ। কৃষি উৎপাদনের একাধিক সূচকে বিশ্বে এখন বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দশে। দেশে জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি কৃষি জমি বরং প্রতি বছর এক শতাংশ হারে কমেছে। এরপরও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বেড়েছে পুষ্টির নিরাপত্তাও। বাংলাদেশের এসব সাফল্যকে বিশ্বে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। এ ছাড়া কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাল, মাছ ও ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে আছে দেশ।

এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরের বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। বাংলাদেশ আজ অনেকের চোখেই বিস্ময়। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় নাম লেখানোর অপেক্ষায়। এটিই এখন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, যা তিনি চেয়েছিলেন।’ সরকারের আন্তরিক চেষ্টায় কৃষি খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম খান। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, সরকার প্রথম থেকেই খাদ্য নিরাপত্তা ও ঘাটতি কমাতে আন্তরিক ছিল। যেভাবে সরকার কৃষি খাতে অর্থিক সমর্থন ও নীতিগত সহায়তা দিয়েছে তা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কৃষি খাতে এ অভূতপূর্ব সাফল্য সরকারের সহায়তা ছাড়া সম্ভব ছিল না।’ তিনি আরো বলেন, ‘গত অর্ধ শতাব্দীতে দেশে শস্যের উৎপাদন গড়ে ৩ শতাংশ হারে বেড়েছে, যেখানে বিশ্বে উৎপাদন বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে দেশের বড় সাফল্য এখন কৃষি। আমাদের চাল উদ্বৃত্ত, বেশকিছু খাদ্যে প্রথম সারির উৎপাদক। শস্যের নতুন জাত উদ্ভাবনে বাংলাদেশ এখন শীর্ষে। অন্যদিকে সরকারি গুরুত্বের কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগও প্রচুর বেড়েছে। সব মিলে উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে, প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতেও।’

জানা গেছে, চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। স্বাধীনতার পর দেশে যে চাল উৎপাদন হতো এখন তার চেয়ে তিনগুণ বেশি উৎপাদন হয়। ওই সময় যেখানে প্রতি হেক্টরে চালের উৎপাদন ছিল দেড় টন তা এখন চার টনেরও বেশি। একইভাবে গম উৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ আর ভুট্টার উৎপাদন হয়েছে ১০ গুণ। ২০২০ সালে গম উৎপাদন হয়েছে ১২ লাখ ৫০ হাজার টন। ২০০৯ সালে ভুট্টার উৎপাদন ছিল সাড়ে ৭ লাখ টন, আর ২০২০ সালে হয়েছে ৫৪ লাখ টন।

প্রধান খাদ্যশস্যের বাইরে নিবিড় চাষের মাধ্যমে দেশে সবজি উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। স্বাধীনতার পর দেশে সবজির উৎপাদন বেড়ে হয়েছে পাঁচগুণ। গত এক দশকে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ আবাদী জমি বৃদ্ধির হার বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও)।

গত বছর সবজি উৎপাদন বেড়ে ১ কোটি ৭২ লাখ ৪৭ হাজার টনে পৌঁছেছে। এর মধ্যে আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম। গত বছর আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ টন। বড় সফলতা এসছে ফল উৎপাদনে। দেশ মোট ফল উৎপাদনে বিশ্বে ২৮তম। কিন্তু মৌসুমি ফল উৎপাদনে গত বছর বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় উঠেছে বাংলাদেশ। এফএওর হিসাবে, ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। একই সঙ্গে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চারটি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, আমে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে বাংলাদেশ।

কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, বছরে ১০ শতাংশ হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে। এক দশকে দেশে আমের উৎপাদন দ্বিগুণ, পেয়ারা দ্বিগুণের বেশি, পেঁপে আড়াই গুণ এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ হারে বেড়েছে।

বড় সাফল্য রয়েছে পানীয় উৎপাদনে। এক সময় চা উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা বাড়ায় আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছিল দেশ। সে পরিস্থিতি কেটে এখন চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেড়েছে। শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে দেশে চা উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি, যা তার আগের বছরের চেয়ে ১ কোটি ৩৯ লাখ কেজি বেশি। লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে নবম।

কৃষি উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে আছে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার ও যন্ত্রের ব্যবহার। এছাড়া বিশেষ অবদান রাখছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। দেশে বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় প্রচুর উচ্চফলনশীল, স্বল্পমেয়াদি ও পরিবেশসহিষ্ণু নতুন জাত উদ্ভাবন হয়েছে। এর মধ্যে ধানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। এ সংস্থার বিজ্ঞানীদের হাত ধরে কৃষকরা ১০০টি নতুন জাতের ধান পেয়েছেন। ধানের সিংহভাগের জোগান আসছে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলো থেকে। ব্রির এসব জাতের মধ্যে ১০টি লবণাক্ততা সহনশীল, রোপা আমনের খরা সহনশীল তিনটি, জলাবদ্ধতা সহনশীল চারটি, পুষ্টিসমৃদ্ধ পাঁচটি এবং রপ্তানিযোগ্য বিশেষ চারটি জাতের ধান রয়েছে।

এদিকে অন্যান্য ফসলের জাত উদ্ভাবনে বড় অবদান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি)। এ প্রতিষ্ঠান দানাশস্য, কন্দ, ডাল, তেলবীজ, সবজি, ফল, মসলা, ফুল প্রভৃতির উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করে আসছে। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বারি বিভিন্ন ফসলের ৫৮৭টি উচ্চফলনশীল জাত এবং ৫৫১টি ফসল উৎপাদন প্রযুক্তিসহ ৯০০টিরও বেশি কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবিত স্বল্পকালীন উন্নত ও উচ্চফলনশীল ধান, গম, সরিষা, মুগ, বাদাম, ছোলা, মসুর, পেঁয়াজ, মরিচ, হলুদসহ ১৮টি ফসলের ১১২টি জাত কৃষকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

এক সময় সার ও বীজ নিয়ে ছিল হাহাকার, সেটা এখন বেশ সহজলভ্য। অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ফসল আবাদের জন্য কৃষক এখন বেশি পরিমাণ গুণগতমান সম্পন্ন বীজ ও সার পাচ্ছেন। এক সময়ের ৮০ টাকার টিএসপি সার ২২ টাকায়, ৭০ টাকার এমওপি ১৫ টাকায় এবং ৯০ টাকার ডিএপি ১৬ টাকায় দেওয়া হচ্ছে।

অপরদিকে বেড়েছে সারের সরবরাহও। আগে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) থেকে বিভিন্ন ফসলের বীজ সরবরাহ করা হতো ২ লাখ ৬১ হাজার ৫৯ টন। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৩ টনে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close