মিনহাজুল ইসলাম, চট্টগ্রাম

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২১

শঙ্কা ‘বিদ্রোহী’দের নিয়ে

দুশ্চিন্তা নিয়েই মাঠে বিএনপি

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে উত্তাপ ছড়াতে পারেন কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই দলের ‘বিদ্রোহী’ ঠেকাতে বার বার কেন্দ্রীয়, নগর ও জেলার শীর্ষ নেতাদের একাধিক বৈঠকের পরও দমানো যায়নি তাদের। ফলে নগরীর সাধারণ ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশেই এবার আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা শক্ত বিরোধিতার মুখে পড়ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, অন্তত ১২টি এলাকায় ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীরা বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন। তবে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের অধিকাংশই সাবেক চসিক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

এদিকে নির্বাচনে সরকার জয় ‘ছিনিয়ে’ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিএনপি। তা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ভোটে টিকে থাকার চেষ্টা করবে দলটি। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও মেয়র পদপ্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন বলেছেন, ‘আমরা মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোটকেন্দ্রে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছি। কিন্তু কিছু মাস্তান, চাঁদাবাজ, ইয়াবা কারবারি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতি উৎসাহী অফিসারের কারণে পরিবেশটা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। আমার রক্ত ঝরবে, তবু বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে কেন্দ্রে কেন্দ্রে যাব।’

কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে আছেন ১নং দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের তৌফিক আহমেদ চৌধুরী, ২নং জালালাবাদ ওয়ার্ডের সাহেদ ইকবাল বাবু, ৯নং উত্তর পাহাড়তলীর জহুরুল আলম জসীম, ১১নং দক্ষিণ কাট্টলীর মোরশেদ আক্তার চৌধুরী, ১২নং সরাইপাড়ার সাবের আহমেদ, ১৪নং লালখান বাজারের এফ কবির মানিক, ২৫নং রামপুরার এস এম এরশাদ উল্লাহ, ২৭নং দক্ষিণ আগ্রাবাদের এইচ এম সোহেল, ২৮নং পাঠানটুলীর আবদুল কাদের, ৩১নং ওয়ার্ডের তারেক সোলায়মান সেলিম, ৩৩নং ফিরিঙ্গীবাজারের হাসান মুরাদ বিপ্লব এবং ৩০নং ওয়ার্ডের মাজাহারুল ইসলাম চৌধুরী। এসব ওয়ার্ডে ‘অপ্রীতিকর ঘটনা’র আশঙ্কা রয়েছে। রীতিমতো আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোটের দিন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারেন। এই আশঙ্কা খোদ আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যেও আছে। এমন খবরে তৎপরতা বাড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সিনিয়র এক কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। যেসব ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন, সেখানে গোয়েন্দা নজরদারিও বেশি থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও তৎপর থাকবেন। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রস্তুত। পুলিশ এরই মধ্যে মাঠপর্যায় থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছে।

সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর জানান, নির্বাচনকে ঘিরে নগরীতে চেকপোস্ট তিনগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। চট্টগ্রামের বাইরের কেউ অসৎ উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম নগরীতে অবস্থান করছে কি না তা নজরদারি করা হচ্ছে। নগরীর ৪টি প্রবেশদ্বারেও কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। এর সঙ্গে বিশেষায়িত সোয়াত টিম, গোয়েন্দা পুলিশ, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট একই সঙ্গে কাজ করছে।

চসিকের পুনঃতফসিল ঘোষণার পরও প্রতি ওয়ার্ডে দলীয় সমর্থিত একজন করে কাউন্সিলর পদপ্রার্থী রাখার জন্য কাজ করে নগর আওয়ামী লীগ। বিদ্রোহীদের আলোচনার মাধ্যমে নিষ্ক্রীয় করতে দফায় দফায় বৈঠক ও নির্দেশ দেওয়া হয় কেন্দ্র থেকে। গত ৪ জানুয়ারি নগরীর দারুল ফজল মার্কেটের দলীয় কার্যালয়ে নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় ‘বিদ্রোহীদের’ ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়েও কথা হয়। নির্বাচন সমন্বয়কারীরা ‘বিদ্রোহীদের’ দল থেকে বহিষ্কারের কথাও বলেছিলেন। তবে কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি।

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে প্রশাসন পেশাদারিত্বের সঙ্গে তা মোকাবিলা করবে বলে বিশ্বাস করি। আওয়ামী লীগ মেয়রসহ কাউন্সিলর পদে যাদের মনোনয়ন দিয়েছে তাদের বিজয়ী করতে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। এখানে কে কোন অবস্থায় আছে আমরা তা বিবেচনা করব না। যারা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে, তাদের দলীয় সদস্যপদ থাকবে না।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, তারা উভয় সংকটে রয়েছেন। একদিকে আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী, অন্যদিকে নেতার অনুসারীর প্রার্থী; ফলে তারা কোনো পক্ষেই নামতে পারছেন না।

অভিযোগ ও শঙ্কা বিএনপির : সিইসি চট্টগ্রামে এসেও কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য পাইনি জানিয়ে বিএনপির প্রার্থী ডা. শাহাদাত বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন কেউ ঘরে থাকতে পারছেন না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যাওয়ার পর থেকে প্রতিটি ঘরে তল্লাশি চালান হচ্ছে, মামলা দেওয়া হচ্ছে, এমনকি সেন্টারে না যাওয়ার জন্য ও এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তারা হুমকি দিয়ে বলছে আমরা যেন কাউকে না দেখি, দেখলে গ্রেফতার করা হবে।’

একই অভিযোগ করে বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য ব্যারিস্টার মীর হেলাল বলেন, ‘চসিক নির্বাচনে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ভোটের অধিকার জনগণ ভোগ করতে পারবে কি না। এই জায়গাটি নিশ্চিত হতে পারলে চট্টগ্রামের মানুষ বিএনপির প্রার্থীকেই বেছে নেবে। কিন্তু আজ (মঙ্গলবার) চট্টগ্রাম নগরীর রাস্তাঘাটে ভোটাদের ভয় দেখানো হচ্ছে। সহিংসতা ও ভোট কারচুপির শঙ্কার কারণে ভোটারদের মধ্যে যে নির্বাচনবিমুখতা বিরাজ করছে, সেখান থেকে বেরিয়ে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেন্দ্রে যাবে ভোটারা।’

এর আগে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল নির্বাচনে ভোট শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ‘পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া’, ‘ভোটে অনিয়ম’ ও ‘কারচুপি’র অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন করেন তৎকালীন বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী এম মনজুর আলম। পরে রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তিনি।

বিএনপির প্রার্থীর প্রধান এজেন্ট ও চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর জানান, ‘নির্বাচনে জয়ের লক্ষ্য নিয়েই বিএনপি এবার মাঠে আছে। জনগণও ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছে। এখন পর্যন্ত বিএনপির সিদ্ধান্তÑ আমরা ভোটের শেষ পর্যন্ত থাকব। তবে সরকার একেক সময় একক পদ্ধতি অবলম্বন করে ভোট কারচুপি করছে।’

পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও সংঘর্ষের প্রচার : সর্বশেষ গত সোমবার রাতে নগরীর ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মো. সালাউদ্দিনের বাসায় দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই সময় তারা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলিও ছুড়ে। এর আগে রবিবার আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীর গণসংযোগে অংশ নিতে গিয়ে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে আহত হন যুবলীগের কেন্দ্রীয় উপপ্রচার সম্পাদক আদিত্য নন্দী। তার আগে গত ১২ জানুয়ারি রাতে ২৮ নম্বর পাঠানটুলি ওয়ার্ডের মগপুকুর পাড় এলাকায় আওয়ামী লীগ ও ‘বিদ্রোহী’ কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলিতে আজগর আলী বাবুল নিহত হন। এছাড়া নগরীর ১১নং দক্ষিণ কাট্টলীতে আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মোরশেদের বাড়ির সামনে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার জহির তানভির (৪০)।

এদিকে চট্টগ্রাম অঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চসিক নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর পর আচরণবিধি ভঙ্গ, হামলা ও হুমকিসহ ৬০টি অভিযোগ জমা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ১২টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে তিনটি অভিযোগ। বাকি ৪১টি অভিযোগ নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীদের। তবে অধিকাংশ আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থীদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ।

ইসির তথ্যানুযায়ী, চসিক নির্বাচনে আগে নির্ধারিত ৭৩৫টি ভোটকেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ৪ হাজার ৮৮৬টি কক্ষে ভোট গ্রহণে দায়িত্ব পালন করবেন ৭৩৫ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ৪ হাজার ৮৮৬ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও ৯ হাজার ৭৭২ পোলিং কর্মকর্তা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close