মিনহাজুল ইসলাম, চট্টগ্রাম

  ২৬ জানুয়ারি, ২০২১

চট্টগ্রাম সিটির ভোট রাত পোহালেই

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের জমজমাট প্রচার শেষ হয়েছে গতকাল সোমবার মধ্যরাতে। নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল সব ভোটকেন্দ্রে মক ভোট বা অনুশীলনমূলক ভোট করা হয়েছে। আগামীকাল বুধবার হবে ভোট। পাড়া-মহল্লায় ভোটাররা এখন ব্যস্ত চুলচেরা বিশ্লেষণে। তবে একাধিক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় প্রার্থীসহ ভোটারদের মধ্যে কিছুটা শঙ্কা কাজ করছে। এদিকে নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী এবং ৪১ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা। গত সাত দিনে ১০টি ‘গায়েবি’ ও ‘সাজানো’ মামলায় সহ¯্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করার অভিযোগ করেন বিএনপি মেয়র পদপ্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। এতে গ্রেপ্তার হওয়া ৬৯ বিএনপি নেতাকর্মীকে মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার না হলে চট্টগ্রাম নির্বাচন কার্যালয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়ে অবস্থান কর্মসূচিতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। গতকাল দুপুরে নগরীর দলীয় কার্যালয় নাসিমন ভবনে নির্বাচনী পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডা. শাহাদাত এ ঘোষণা দেন।

অপরদিকে চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেছেন, ‘বিএনপি ঘুম থেকে ওঠে ষড়যন্ত্র দেখে। তারা সবকিছুতেই ষড়যন্ত্র খুঁজে। কারণ ষড়যন্ত্র থেকেই তাদের জন্ম। আওয়ামী লীগ মনে করে, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস, বন্দুকের নল নয়।’ গতকাল দুপুর দেড়টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এ মতবিনিময় হয়।

গতকাল মধ্যরাতেই শেষ হয়েছে প্রার্থীদের টানা ১৮ দিনের প্রচার। শেষ মুহূর্তে প্রচারের উচ্ছ্বাসে আচরণবিধিরও ধার-ধারেননি অনেক প্রার্থী। গণসংযোগ-পথসভার নামে বিশাল জনসভা করেছেন তারা। আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনেরও অভিযোগ উঠেছে। তবে নির্বাচনে কালোটাকা ছড়ানোর অভিযোগও করেছেন আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী।

এদিকে নির্বাচনী প্রচারর শেষ দিনেও পরস্পরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ না হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী শাহাদাত হোসেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের হয়রানি ও নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করার অভিযোগ করেছেন তিনি। গত রবিবার রাতে বিএনপির ২০ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন অফিসে আবেদন করেছেন বিএনপির প্রার্থী।

চসিক নির্বাচনে মেয়র পদে প্রধান দুই দলের প্রার্থীসহ ৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বী। এছাড়া ৪১ সাধারণ ওয়ার্ডে ১৭২ জন এবং ১৪ সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৫৭ কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এবার ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ ভোটার তাদের ভোটাদিকার প্রয়োগ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ভোটারদের মধ্যে পুরুষ ৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৩ এবং মহিলা ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৩ ভোটার।

নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি বিষয়ে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও চসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান জানান, সোমবার মধ্যরাত থেকে নির্বাচনী এলাকায় সব ধরনের প্রচার-প্রচারণা বন্ধ হয়ে যাবে। নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য মাঠে রয়েছেন। তাদের সব ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভোটগ্রহণের জন্য ১১ হাজার ৫৭২টি ইভিএম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণও শেষ করা হয়েছে। গতকাল সবগুলো ভোটকেন্দ্রে অনুশীলন বা মক ভোট করা হয়েছে। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোটারদের ইভিএম ভোট দেওয়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দেন প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তারা।

গণবিজ্ঞপ্তিতে থেকে জানা যায়, বিধি অনুযায়ী, কোনো নির্বাচনী এলাকার ভোটগ্রহণ শুরুর পূর্ববর্তী ৩২ ঘণ্টা, ভোটগ্রহণের দিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা এবং ভোটের দিন রাত ১২টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা নির্বাচনী বিশেষ ব্যবস্থা বলবদ থাকবে। ফলে ২৬ জানুয়ারি রাত ১২টা থেকে ২৯ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় কোনো ব্যক্তি কোনো জনসভা আহ্বান, অনুষ্ঠানে যোগদান এবং কোনো মিছিল বা শোভাযাত্রা করতে পারবেন না। এই সময়ে অস্ত্রবহন ও নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা যাবে না। গত বৃহস্পতিবার নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার স্বাক্ষরিত গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।

রিটার্নিং অফিস সূত্রে জানা গেছে, চসিক নির্বাচনে এবার নগরীর ৭৩৫টি কেন্দ্রের ৪ হাজার ৮৮৬টি বুথে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ হবে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে এরই মধ্যে ভোটের জন্য প্রস্তুতি রাখা হয়েছে ১১ হাজার ৫৭২টি ইলেকট্রনিক ভোটার মেশিন (ইভিএম)। মাঠে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ২০ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সংক্রান্ত তথ্যে জানা যায়, নির্বাচনের মাঠে ২৫ প্লান্টুন বিজিবি, ৪৯২ জন র‌্যাব, ৪ হাজার ৩০৮ পুলিশ এবং ৮ হাজার ৮২০ আনসার সদস্য মিলিয়ে মোট ১৪ হাজার ৩৭০ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। মোবাইল টিম থাকবে ৪১০টি, স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে ১৪০টি। প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে মোট ৭৬ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। সেই সঙ্গে সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ১৬ জন এবং গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৮ জন করে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। ইভিএমের কারিগরি সহায়তায় প্রতি ভোট কেন্দ্রেতে সশস্ত্রবাহিনীর দুজন সদস্য নিয়োগ থাকবেন।

গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি চসিক নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী ২৯ মার্চ ভোটগ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ায় সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে ২১ মার্চ নির্বাচন স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। গত ৫ আগস্ট মেয়াদ শেষে বিদায় নেন চসিকের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ ৪১ জন সাধারণ ওয়ার্ডের ও ১৪ জন সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা। নতুন তফসিল অনুযায়ী গত ৮ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়। ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী তারেক সোলেমান সেলিমের মৃত্যুতে ওই ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মো. হারুনুর রশিদ।

বিএনপি ঘুম থেকে ওঠে ষড়যন্ত্র দেখে : গতকাল চট্টগ্রামে প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। চসিক নির্বাচনের দিন নগরীর বাসিন্দাদের সাধারণ ছুটি না দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, চট্টগ্রামে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রার্থীরা উৎসবমুখর পরিবেশে প্রচারণা চালাচ্ছেন। ভোটাররাও উন্মুখ হয়ে আছেন ভোট দেওয়ার জন্য। এক্ষেত্রে সাধারণ ছুটি কোনো প্রভাব ফেলবে না।

নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আহমদ হোসেন বলেছেন, ‘বিএনপির প্রার্থী জনবিচ্ছিন্ন, তাই পুলিশ দিয়ে নিরাপত্তা দিতে হচ্ছে। আমাদের প্রার্থীর পাশে জনগণ আছে। এজন্য আমাদের প্রার্থীর কোনো নিরাপত্তার দরকার নেই। আমাদের প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন ভোটাররা। ভোটাররাই নিরাপত্তার প্রাচীর গড়ে তুলবেন।’

এ সময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ, বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, যুগ্ম সম্পাদক শাহজাদা মহিউদ্দীন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন প্রমুখ।

গ্রেপ্তার বন্ধ না হলে অবস্থান : বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের ঠিক ছয় মাস আগে থেকে যে ধরনের মামলা দেখেছি, ১৯ জানুয়ারি থেকে প্রতিটি থানায় সেই ধরনের ১০টির বেশি মামলা করা হয়েছে। এতে ১ হাজারের বেশি আসামি করা হয়েছে। গত রোববার রাত পর্যন্ত ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে নাগরিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক একরামুল করিম, তার ছেলে এবং নারী ও শিশুরা আছেন।

ডা. শাহাদাত বলেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে মারামারিতে তিনজন নিহত হয়েছেন, আমাদের কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়েছে, প্রচার গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের হয়রানি চলছে। সিইসি চট্টগ্রাম এসেছিলেন। এসব বিষয়ে সিইসি বক্তব্য দেবেন বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু সেরকম কিছু পাইনি। চট্টগ্রামের নির্বাচন কর্মকর্তাকে আমরা এখন পর্যন্ত ৪০টি অভিযোগ দিয়েছি। এসবের কোনো সমাধান হয়নি।

পুলিশি হয়রানির অভিযোগ করে ডা. শাহাদাত বলেন, রবিবার রাতে বাকলিয়া থানায় বিএনপি নেত্রী মুন্নি ও তার ১২ বছরের শিশুকে ধরে নিয়ে গেছে। নাগরিক ঐক্য পরিষদের বীর মুক্তিযোদ্ধা একরামুল করিমকে ছেলেসহ বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেছে চকবাজার থানা পুলিশ। অথচ তার ছেলে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, সদস্য ব্যারিস্টার মীর হেলাল, নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর, নাগরিক ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান একরামুল করিম, দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান প্রমুখ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close