নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৬ জানুয়ারি, ২০২১

উত্তরায় ২০ স্পটে দিনে চাঁদা ২৫ লাখ টাকা!

* রাস্তার পাশে ও ফুটপাতে অস্থায়ী দোকান বসিয়ে টাকা নেওয়া হয় * বাস, অটোরিকশা ও হিউম্যান হলার থেকেও তোলা হয় চাঁদা

রাজধানীর উত্তরা এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবক সুমন চলতেন টিউশনি করে অর্থাৎ ছাত্র পড়িয়ে। নভেল করোনাভাইরাস মহামারির কারণে টিউশনগুলো বন্ধ হয়ে যায় তার। বাধ্য হয়ে হাউসবিল্ডিং এলাকায় সোনারগাঁও জনপদ রোডে ফুটপাতে ভ্যানে করে কাপড় বিক্রি করতে নামেন তিনি। নানা ধরনের শীতের পোশাক বিক্রি করে দিনে হাজার টাকার মতো আয় হচ্ছিল তার। তবে সুমনের আক্ষেপ, এই আয়ের প্রায় অর্ধেকই তুলে দিতে হয় স্থানীয় চাঁদাবাজদের হাতে। তাদের বেশির ভাগই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। হকারদের মধ্য থেকেও কেউ কেউ আসে স্থানীয় থানা-পুলিশের হয়ে চাঁদা তুলতে।

শুধু সুমনের ভ্যানই নয়, উত্তরা এলাকায় রাস্তা ও ফুটপাতের অবৈধ দোকান, বাস-টেম্পোর স্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন স্পটে নিয়মিত চলে চাঁদাবাজি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, উত্তরা এলাকার ২০ স্পটে প্রতিদিন চাঁদা আদায় হয় অন্তত ২৫ লাখ টাকা।

হাউসবিল্ডিং এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সুমনের ভ্রাম্যমাণ দোকানের মতো আরো পাঁচ শতাধিক দোকান বসে ফুটপাতে এবং রাস্তার পাশে। সব দোকানিকেই প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয়। ভুক্তভোগী সুমন বলেন, রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে চিহ্নিত চাঁদাবাজরা রাস্তা দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের টাকা না দিলে ফুটপাতে দোকান বসানোর সাধ্য কারো নেই। তার অভিযোগ, টাকার মেশিন অর্থাৎ অর্থ কামানোর হাতিয়ার হিসেবে এই চাঁদাবাজরা রাজনৈতিক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বিশেষ কদর পায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক পরিচয়ধারী অনেক চাঁদাবাজ ফুটপাতের অবৈধ দোকান থেকে শুরু করে নামিদামি শপিং মলে দোকানের পজিশন নিয়ে মালিক বনে গেছে।

সম্প্রতি ঢাকা-১৮ (উত্তরা) আসনের উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন হাবিব হাসান। শপথ নেওয়ার পর বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তিনি এলাকায় চাঁদাবাজি বন্ধ করার বিষয়ে কড়া হুশিয়ারি দিয়েছেন। এমপি হাবিব হাসান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘অনেকে অনেকভাবে গরিব মানুষের কাছ থেকে টাকা উঠিয়ে খায়। এটা ঠিক নয়। যেসব নেতা এসব কাজ করেন, তারা দলের জন্য বোঝা, তারা আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্জিত সাফল্যকে কলঙ্কিত করছেন।’ তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে কমিটিতে তাদের ব্যাপারে অবশ্যই চিন্তাভাবনা করা হবে। রাজনীতির নামে রাস্তাঘাট দখল করে, চাঁদাবাজি করে খাবে, আমরা এ সংস্কৃতি রাখতে চাই না। যারা রাজনীতি করেন, চাঁদাবাজি করেন, তাদের এটা বুঝতে হবে। আমি উত্তরা এলাকায় এসব চাঁদাবাজি চলতে দেব না। যা শপথ নেওয়ার প্রথম দিন থেকেই বলে আসছি, তা বাস্তবায়ন করব ইনশাআল্লাহ।’

চাঁদাবাজির ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা জোনের উপকমিশনার মো. শহীদুল্লাহ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘রাস্তা আটকে কোনো দোকানপাট বসলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। তা ছাড়া পরিবহনের চাঁদাবাজির বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ভুক্তভোগীসহ স্থানীয় অনেক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উত্তরায় প্রায় ২০ স্পটে প্রতিদিন টাকা তুলে অন্তত ২০-৩০ চিহ্নিত চাঁদাবাজ। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাসহ কাউন্সিলররা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন বলে অভিযোগ আছে। এসব স্পট থেকে রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রতিদিন চাঁদা উঠে প্রায় ২৫ লাখ টাকার বেশি। চাঁদার এ টাকার বড় অংশ যায় রাজনৈতিক রাঘববোয়ালদের পকেটে, কিছু যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু সদস্যদের হাতে। চাঁদা তোলার কাজে অপরিচিত লোকদের ব্যবহার করা হলেও পেছনে আছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, তার আত্মীয়সহ প্রতিটি থানার বড় রাজনৈতিক নেতারা। রাজনীতি করতে, মিটিং-মিছিল করতে খরচ লাগে এমন অজুহাতে উত্তরার প্রতিটি থানার অনেক নেতা চাঁদা তোলার সঙ্গে জড়িত।

সরেজমিনে গিয়ে উত্তরার বিভিন্ন রাস্তাঘাট ঘুরে চাঁদা তোলার ২০টি জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। রাজউকের জায়গা দখল করে অবৈধ দোকানপাট, ফুটপাতসহ ৯-১০টি স্পট এবং আন্তজেলা পরিবহন, টেম্পো, হিউম্যান হলার বা লেগুনা স্ট্যান্ডসহ ১০টি জায়গা থেকে চাঁদা ওঠে। এর বাইরেও অনেক স্পটে চাঁদাবাজি চলে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। উত্তরার আবদুল্লাহপুর এলাকায় অন্তত চারটি জায়গা থেকে প্রতিদিন চার-পাঁচ লাখ টাকা আদায় করা হয়। বেড়িবাঁধ হয়ে উত্তরখানের রাস্তায় চলাচল করা তিন শতাধিক অটো থেকে টাকা তোলা হয় প্রতিদিন দুই ব্যক্তির নেতৃত্বে। এর বড় অংশ যায় এক জনপ্রতিনিধি এবং দুই রাজনীতিকের নামে। হাউসবিল্ডিং এলাকায় টেম্পো ও ফুটপাতের দোকান থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ওঠে। আজমপুর ফুটপাত, রাজউক, কাঁচাবাজার, দুইপাড়ের অটো ও টেম্পো থেকে যে টাকা তোলা হয়। সোনারগাঁও জনপদ রোডে দখল ও চাঁদাবাজি চলে দুই জনপ্রতিনিধিসহ বেশ কয়েকজন রাজনীতিকের নামে। রাজলক্ষ্মী এলাকায় চাঁদা তোলা হয় অন্তত পাঁচ নেতার নামে। এলাকার বিভিন্ন পরিবহনের চাঁদাবাজির সঙ্গেও রাজনৈতিক নেতারা জড়িত। বিমানবন্দর ও আশপাশের এলাকায় একজন কাউন্সিলরের নামে চাঁদাবাজি চলে অন্তত পাঁচ জায়গায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close