গাজী শাহনেওয়াজ

  ১২ আগস্ট, ২০২০

করোনার ধাক্কায় কাজ কমেছে মেট্রোরেলের

* ফিরে আসার ব্যাপারে সাড়া নেই জাপানিদের * বাড়বে প্রকল্পের ব্যয় ও সময়

রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকায় আছে ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) বা মেট্রোরেল প্রকল্পটি। বিশ্বব্যাপী চলমান করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তারে এই কাজেও প্রভাব পড়ে। বর্তমানে যে ধীরগতিতে কাজ এগোচ্ছে তাতে বলা যায় মেট্রোরেল প্রকল্পটি খেই হারিয়ে ফেলেছে। শুধু মেট্রোরেল নয়, পদ্মা সেতুসহ অনেক প্রকল্পে মরণঘাতী করোনার প্রভাব পড়েছে। তবে মেট্রোরেল প্রকল্পে বড় ধাক্কা লেগেছে সুপারভিশনের দায়িত্বে থাকা জাপানি ইঞ্জিনিয়ারদের পুরো টিমের অনুপস্থিতির কারণে। তাদের সংখ্যা অর্ধশত। দেশে করোনার বিস্তার ঘটার পর পরই স্বদেশে ফেরেন জাপানি নাগরিকরা; তাদের এখনো ফেরার খবর নেই। আবার যারা ঢাকায় আছেন তাদেরও পা পড়েনি গত কয়েক মাসে এ প্রকল্প চত্বরে। তাদের কাজে ফেরাতে চিঠি চালাচালিতে রয়েছে সীমাবদ্ধ। ফলে তাদের কারণে অন্যান্য দেশের (থাইল্যান্ড ভারত ও চায়না) যারা এই প্রকল্পে যুক্ত আছেনÑ তাদের বসিয়ে বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বহুগুণ বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের। তাই মেট্রোরেলের কাজে গতি ফেরাতে জাপানের নাগরিকদের কাজে ফেরাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ সরকার।

প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানান, মেট্রোরেল প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত জনবলের সংখ্যা ৯ হাজার জনের মতো। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারণে মাত্র ৩০ শতাংশ জনবল দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলছে এর কার্যক্রম। বলা যায়, ঢিমেতালে চলছে মেট্রোরেল প্রকল্পের সব কার্যক্রম।

কারণ এই প্রকল্পের শতাধিক কর্মকর্তা ও শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর মেট্রোরেল-৬ প্রকল্পে ১২ জন ও মেট্রোরেল-১ প্রকল্পের ৩৮ জন জাপানি পরামর্শকরা মূল কাজের তদারকি করেন। তাদের অনুপস্থিতিতে অন্যান্য দেশের পরামর্শকদের কর্মহীন অলস সময় পার করতে হচ্ছে। কেননা প্রকল্পের নকশার কাজটি তারাই (জাপানি) তদারকি করেন। আর এর আলোকে প্রকল্প আলোকমুখ দেখেন। মূল পরিকল্পনার ঘাটতিতে কাজ এগিয়ে নেওয়া এখন দুরূহ হয়ে উঠেছে।

প্রকল্পের এমডি ও সাবেক সচিব এম এ এন সিদ্দিক বলেন, মেট্রোরেল প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের একটি। চেষ্টা করছি নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও কাজটি নির্ধারিত সময়ে শেষ করার। এ জন্য নির্মাণ শ্রমিকসহ এখানে কর্মরত সবাইকে বাড়তি শ্রম দিতে হবে; আমরা কাউন্সিলিং করে তাদের মনোবল চাঙা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, এখনো জাপানি নাগরিকরা কাজে ফেরেননি। করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পর তারা দেশ ত্যাগ করেন। আমি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কারণ ব্যাখ্যা করে চিঠি দিয়েছি। সেখান থেকে নোট ভারবাল দিয়ে জাপানি দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, তারা এখানে আসতে পারছেন না জাপানি সরকারের বিধি-নিষেধের কারণে।

প্রকল্পের এমডি বলেন, মহামারি পরিস্থিতির প্রথম দিন থেকেই স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ সীমিত পরিসরে শুরু করা হয়। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে কাজের পরিধি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে।

সরেজমিন প্রকল্প এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানী মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে দৈনিক বাংলা, পুরানা পল্টন ও প্রেস ক্লাব কোথাও কোনো কাজ হচ্ছে না মেট্রোরেলের। ছয় লেন সড়কের মাঝখানে বাউন্ডারি দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে চারলেন সড়ক। মতিঝিল থেকে প্রেস ক্লাব পর্যন্ত একটি ব্যস্ত সড়কে এভাবে আটকে রাখা হয়েছে মেট্রোরেলের কারণে। বেশির ভাব এলাকায় কংক্রিটের পিয়ার (খুঁটি) তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ রয়েছে প্রকল্পের কাজ। তবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় ধীরগতিতে চলছে স্টেশন নির্মাণের জন্য পাইলিংয়ে কাজ। যদিও একদিন কাজ করা হলে দুই দিন বন্ধ থাকে বলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা জানান। তাদের ভাষ্যমতে, করোনা আক্রান্তের কারণে শ্রমিক কাজে ফিরছে না এবং সরঞ্জাম সংকটে কাজ চলছে ঢিমেতালে।

পরিচয় গোপন করে কথা হয় নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে। তারা বলেন, আপনার পরিচয়, আমি বললাম পথচারী। পরে বলেন, করোনাভাইরাসের ভয়ে আতঙ্কে অনেক শ্রমিক কাজে ফিরছেন না। বেঁচে থাকলে কাজ মিলবে একথা বলে অনেকেই কাজ ফেলে গ্রামে চলে গেছে। এছাড়া জাপানিরা সেই মার্চ মাসে গেছে আর আসে না। জাপানিদের নির্দেশ ছাড়া ইঞ্জিনিয়ার কাজ বুঝে না। করোনার শুরুতে কিছুদিন কাজ ভালোই চলছিল। কিন্তু শ্রমিক ও কর্মকর্তারা করোনা আক্রান্ত হলে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়া রোজার ঈদের আগে জাপানিরা চলে যাওয়ার পর কাজ একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রকল্প সূত্র জানায়, রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ নির্মাণ করা হচ্ছে এই মেট্রোরেল-৬ প্রকল্প। এ পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৪৬ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল)। একটি ট্রেনের ছয়টি করে কোচ থাকবে। প্রতি ৪ মিনিট পরপর ১ হাজার ৮০০ যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে মেট্রোরেল। ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা হবে।

রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। প্রাথমিকভাবে উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরে তা কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিট ১৬ কিলোমিটার বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমানে মতিঝিল পর্যন্ত পিয়ার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, প্রকল্পের প্রারম্ভিক শুরুর স্থান উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত রেলপাত বসানোর কাজ হয়েছে। তবে করোনাভাইরাসের শুরুর পর থেকে প্রকল্পের কাজের গতি কমে গেছে। প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়া হচ্ছে। করোনা চিকিৎসায় জন্য প্রকল্প এলাকায় দুটি ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্টরা জানান।

প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে হিসাব শাখায় কাজ করা একজন বলেন, এগুলো কাগজে কলমের হিসাব। পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হতে আগামী ২০২৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। এখানে বিদেশি শ্রমিকরা প্রকল্পের নামে হরিলুট চালায়। দেশীয় শ্রমিকদের মজুরি যা দেওয়া হয় তাদের এর তিন গুণ বেশি নেয়। এর পরও তাদের গুরুত্ব বেশি থাকে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close