বিনোদন প্রতিবেদক

  ০৭ জানুয়ারি, ২০২৫

পরপারে ঢাকাই সিনেমার রঙিন নবাব

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে নবাব সিরাজ উদ্দৌলাকে নিয়ে খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেছিলেন ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ সিনেমাটি। যে সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কিংবদন্তী অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনেক পরে প্রদীপ দে নির্মাণ করেন ‘রঙ্গিন নবাব সিরাজউদ্দৌলা’। এতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন দেশের বরেণ্য অভিনেতা প্রবীর মিত্র। সেই গুণী অভিনেতা প্রবীর মিত্র গত রবিবার রাত ১০.১৫ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮৪।

গতকাল বাদ জোহর প্রবীর মিত্রের দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বিএফডিসিতে বাদ জোহর নামাজে জানাজা’র পর তাকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। প্রবীর মিত্রের দুই পায়ের হাটুতে সমস্যার কারণে দীর্ঘ ১৬ বছর যাবত ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। বড় ছেলে মিঠুন ও মেজ ছেলে নিপুণের কাছেই একসঙ্গে ছিলেন ছিলেন রাজধানীর ধানমণ্ডির আট নম্বর রোডের এক বাসাতে। জীবনের শেষ সময়টা সেখানেই একটি ঘরেই সময় কাটে প্রবীর মিত্রের। মিথুন তার স্ত্রী, মিথুনের ছোট ভাই নিপুণ তার স্ত্রী যথেষ্ট সময় দেবার চেষ্টা করেন তাদের বাবাকে। দীর্ঘ চার বছর যাবত এই বাসাতে ছিলেন প্রবীর মিত্র। মিঠুনের ভাষ্য ছিল এমন, একদমই কোনো খোঁজ খবর রাখতেন না প্রবীর মিত্রের দীর্ঘদিনের কর্মস্থলের প্রিয়জনেরা। প্রবীরমিত্রের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিলেন কিংবদন্তী অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান। তার সঙ্গে শেষবার আড্ডাও দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেষমেষ তা আর হলো না। জীবনের শেষ সময়ে এসে কাউকে আর এক নজর দেখারও আগ্রহ প্রকাশ করেননি এই অভিনেতা।

মিথুণ জানান, তার বড় বোন ফেরদৌস পারভীন প্রায়ই তাদের বাসায় আসতেন বাবাকে দেখতে। সবাই মিলে বাবাকে একটু আনন্দ দেবার চেষ্টা করতেন। মিথুন জানান, তার মা নাজমুন্নাহার মারা গেছেন ২০০০ সালে। আর তার ছোট ভাই আকাশ ২০১২ সালে মারা গেছেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন অভিনয়শিল্পীর অভিনয়ের স্থান থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের সরিয়ে নিতে হয় যেন তারই প্রমাণ বহন করছিলেন প্রবীর মিত্র। যে কারণে প্রবীর মিত্রের মতো একজন গুণী শিল্পী ‘বৃদ্ধাশ্রম’ নামক একটি চলচ্চিত্রেই সর্বশেষ অভিনয় করেন। শুধু সিনেমাপ্রেমী দর্শকের কাছেই নয় প্রবীর মিত্র তার সহকর্মীদের কাছেও ভীষণ প্রিয় ছিলেন। কিন্তু তেমন কেউই তার খোঁজ রাখতেন না।

সবসময়ই সাদাসিদে জীবন পছন্দ ছিল প্রবীর মিত্রে। যে কারণে উচ্চাভিলাষ তাকে কখনোই পেয়ে বসেনি। জীবনের মতো করেই তার জীবনের নিয়মে জীবন চলে যাচ্ছিল। বয়স বাড়ছিল, তাও মেনে নিয়েছিলেন। আর তাই সব মেনে নিয়েই চলচ্চিত্র থেকে অনেকটা দূরেও চলে গিয়েছিলেন তিনি। বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নয়নের আলো’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রবীর মিত্র। প্রবীর মিত্রের ভাষায় তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ‘রিমার্কেবল’ ছবি ‘নয়নের আলো’। সুমিতা দেবী এই ছবিতে প্রবীর মিত্রের অভিনয় দেখে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পাও তাহলে অভিনয় ছেড়ে, এই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেও’। কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না মিললেও প্রবীর মিত্র তার দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে, ভালোবাসার জায়গা থেকে অভিনয়ই করে গেলেন আজীবন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সে ছবিতে না পেলেও পরে তিনি মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পেয়েছিলেন।

যাই হোক একবার রাজেশ খান্না ও শাবানাকে নিয়ে প্রমোদ চক্রবর্তী ‘বিরোধ’ ছবিটি নির্মাণের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকায় এসে তিনি প্রযোজক হাবিবুর রহমানের কাছে ঢাকার কয়েকটি ছবি দেখতে চাইলেন। তখন তাকে ‘নয়নের আলো’ এবং ‘ছুটির ঘণ্টা’ এই ছবি দুটো দেওয়া হয়। দুটি ছবিই প্রমোদ চক্রবর্তী মনোযোগ দিয়ে দেখেন। ফেরার সময় বিমান বন্দরে হাবিবুর রহমানকে বলছিলেন, ‘নয়নের আলো ছবির সেকে- হাফ আমার ভীষণ ভালোলেগেছে। প্রবীর মিত্রকে আমাকে দিয়ে দেন।’ জবাবে তখন হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সে তো অনেক ব্যস্ত। যেতে পারবেনা’। যাই হোক পরবর্তীতে প্রমোদ চক্রবর্তীর সঙ্গে বোম্বেতে শূটিং করতে শাবানাও যান। তার কাছেও প্রমোদ চক্রবর্তী প্রবীর মিত্রের না যাওয়া নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। একদিন এম এ সামাদ পরিচালিত ‘শিরী ফরহাদ’ ছবির শুটিংয়ের সময় বিএফডিসির চার নম্বর ফ্লোরের মেকাপ রুমে মেকাপ নিচ্ছিলেন প্রবীর মিত্র। তাকে দেখে শাবানা চিৎকার দিয়ে উঠলেন। প্রবীর মিত্র খানিকটা ভয় পেয়ে এফডিসির পুকুর পাড়ে শুটিংয়ে চলে গেলেন। সেখানে শাবানা তাকে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘প্রমোদ চক্রবর্তী আপনাকে ডাকলেন, আর আপনি গেলেন না! এটা কী করে মেনে নেই!’।

প্রবীর মিত্রকে ঘিরে এতসব ঘটনা কিন্তু বেলাল আহমেদের ‘নয়নের আলো’ ছবির জন্যই। চলচ্চিত্রে প্রবীর মিত্রের অভিষেক ঘটে এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ ছবিতে অভিনয়ের মধ্যদিয়ে। মূলত ছবিতে কাজের ব্যাপারে তার বন্ধু এটিএম শামসুজ্জামানই তাকে সহযোগিতা করেছিলেন। ‘জলছবি’র পর নায়ক হিসেবে প্রবীর মিত্র ‘চাবুক’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘জালিয়াত’, ‘তীর ভাঙ্গা ঢেউ’, ‘বড় ভালো লোক ছিলা’, ‘রামের সুমতি’, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’সহ আরো বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন। তবে এইচ আকবর পরিচালিত ‘জীবন তৃষ্ণা’ ছবিতে শিল্পী আব্দুল জব্বারের গাওয়া ‘এ আঁধার কখনো যাবেনা মুছে আমার পৃথিবী থেকে’ গানটি তাকে ব্যাপকভাবে পরিচিতি এনে দেয়। ১৯৮২ সালে তিনি মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘বড় ভালো লোক ছিল’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এরপর আরো বহু চলচ্চিত্রে তিনি অনবদ্য অভিনয় করেছেন। তার ভাগ্যে জুটেনি কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। তবে চলচ্চিত্রে ‘আজীবন সম্মাননা’ পেয়েছেন তিনি ২০১৮ সালে। আরো পেয়েছেন ‘প্রযোজক সমিতি অ্যাওয়ার্ড’, ‘জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার’, ‘বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট সম্মাননা’, ‘মাদার তেরেসা স্মৃতি পদক-২০১৭’, ‘বাবিসাস সম্মাননা ২০০৮ ও ২০১০’, ‘এজেএফবি স্টার অ্যাওয়ার্ড’, ‘জাগো বাংলা সম্মাননা’, ‘আমরা কুড়ি সম্মাননা’, ‘মহানগরী অ্যাওয়ার্ড’, ‘দর্শক ফেরাম অ্যাওয়ার্ড’, ‘ঢাকা কালচারাল রিপোর্টার্স ইউনিটি অ্যাওয়ার্ড’সহ আরো বহু সম্মাননা।

প্রবীরমিত্রের দুই বোন, একজন স্বরস্বতী বসূ অন্যজন রমা সরকার। ছোট ভাই সুবীর কুমার মিত্র। রাজধানীর তাঁতীবাজারের হরিপ্রসণ্ণ মিত্র রোড প্রবীর মিত্রেই দাদার নামে। প্রবীর মিত্রে বাবা গোপেন্দ্র নারায়ণ মিত্র এবং মা অমিয় বালা মিত্র। নায়ক হিসেবে প্রবীর মিত্রের প্রথম চলচ্চিত্র ছিল জহির রায়হানের শেষ সহকারী শেখ নজরুল ও ইলতুত মিস পরিচালিত ‘চাবুক’। এতে প্রবীর মিত্রের নায়িকা ছিলেন কবরী। অভিনয়ের পথচলায় বহু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। অনেক প্রযোজক পরিচালকের কাছে টাকা পাওনা ছিলেন তিনি। কিন্তু জীবদ্দশায় তিনি সেসব টাকা তিনি পাননি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close