হাফিজ উদ্দীন আহমদ

  ১৮ জুলাই, ২০২১

ভ্রমণ

টাইগার টেম্পল

একটু পরেই আমরা থাইল্যান্ডের কাঞ্চনবুড়িতে ব্যাঘ্র মন্দিরে এসে পৌঁছালাম। প্রথমেই টিকিট কাটতে হলো। টিকিট কাটার সময় আমাদের দুজনের জন্য দুটা ফরম দেওয়া হলো; যাতে ইংরেজিতে যা লেখা তার সারমর্ম হলো : এই বাঘগুলো পালিত হলেও তাদের বন্যস্বভাব যায়নি। সুতরাং কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। এটা জেনেই আমি প্রবেশ করছি। নিচে পুরো নাম, পাসপোর্ট নম্বর, দেশের ও স্থানীয় ঠিকানা। ভেতরে ঢুকে দেখি স্থানটা খোলামেলা পাহাড়ি এলাকা। প্রথমেই একটা উন্মুক্ত প্রান্তর। কিছু গাছপালা আছে। পায়ের নিচে রুক্ষ লালচে মাটি। শুরুতেই পড়ল একটি কাঠের ফলক, তাতে তিরচিহ্ন দিয়ে ক্রমান্বয়ে ওপর থেকে নিচে লেখা : টাইগার ক্যানিয়ন, টাইগার কেজেস, প্যাভিলিয়ন। এক স্থানে সিমেন্টের বিরাট নামফলক : টাইগার টেম্পল।

ফলক পার হয়ে আরো বেশ কিছু এগিয়ে যাওয়ার পর নজরে এলো অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়। সবাই লাইন দিয়ে আছে। লাইনটা প্রায় সিকি মাইলের মতো লম্বা। লাইনের সামনে একটি টেবিল। টেবিলের অপর পার্শ্বে এক সুন্দরী শ্বেতাঙ্গিনী তরুণী ও স্থানীয় একজন পুরুষ বসা। তারপর রয়েছে একটি কাঠের ব্যারিকেড, যাতে কেউ ওপাশে যেতে না পারে। ওদিকটা ঢালু পাহাড়ি এলাকা। ঢালু অংশে কয়েকটি পাহাড়ি শৃঙ্গ। পাহাড়গুলো লালমাটির, তাতে গুহাও রয়েছে। ঢালু অংশটি ক্রমেই একটি গিরিপথের রূপ নিয়ে সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ধীরে ধীরে গহিন অরণ্যে হারিয়ে গেছে। স্থানটার নাম টাইগার্স ডেন বা বাঘের গুহা। পাঁচ-ছয়টা বিশালাকার বাঘ চড়ে বেড়াচ্ছে সেখানে। লাইনের বিশালতা দেখে ঘাবড়ে গেলাম। এত বড় লাইন। এখন ঘড়িতে বেলা ৩টার একটু বেশি। ৬টার দিকে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। সন্ধ্যার পর কাউকে আর বাঘের গুহায় ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয় না। এখন মনে হচ্ছে, আমাদের টিকিট করে আসা বৃথাই যাবে। লাইনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও দেখি তেমন এগোচ্ছে না ওটা। ঘড়িতে ৪টা বেজে গেছে অর্থাৎ সন্ধ্যার ভেতর অর্ধেক লোকও ভেতরে বাঘের কাছে যেতে পারবে কি না সন্দেহ। শেষ পর্যন্ত লাইন ছেড়ে সামনে চলে এলাম টেবিলের কাছে। শ্বেতাঙ্গিনীর কাছে অনুরোধ করতেই ঢুকবার অনুমতি দিয়ে দিলেন। কিন্তু যখন ঢুকতে যাব, তখন আবার আটকে দিলেন। স্পষ্ট ইংরেজিতে বললেন, পেছনে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ঢুকতে হবে। এই প্রথম থাইল্যান্ডে এমন একজন পেলাম যিনি বিশুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলেন। শুধু তাই নয়, তিনি বেশ সুন্দরীও বটে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম তার বাড়ি নরওয়ে। বর্তমানে তিনি থাইল্যান্ডের অধিবাসী। ইংরেজিতে কথা বলার সুযোগ পেয়ে জানালাম আমরা টিকিট করে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি, ভয় পাচ্ছি সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আবার হেসে তিনি বিকল্প পদ্ধতির কথা বললেন। আমরা জনপ্রতি ১ হাজার বাথ দিয়ে বিশেষ ভিআইপি টিকিট কিনলে এখনই ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। অর্থাৎ মূল টিকিটের পর আরো ২ হাজার বাথ অতিরিক্ত। আমি খুব উৎসাহবোধ করলাম না।

: দরকার নেই বাবা। এভাবেই দেখি ঢুকতে পারি কি না।

কিন্তু প্রেটি কি সে কথা শোনে? সে তক্ষুনি গিয়ে দুটো টিকিট নিয়ে এলো।

: আব্বু, ওয়েট করলে শেষে হয়তো চান্সই পাব না।

বলল সে।

: তাছাড়া আর যদি টাইগার টেম্পলে আসা না হয়!

ভাগ্যিস, সেদিন প্রেটির কথা শুনেছিলাম। এখন শুনেছি সরকার টাইগার টেম্পল বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ওখান থেকে নাকি আন্তর্জাতিক বাজারে জীবজন্তু পাচার হয় এবং বাঘগুলোর ঠিকমতো যতœ নেওয়া হয় না। টিকিট হাতে আবার মহিলার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মহিলা জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালেন।

: হু উইল টাচ দি টাইগার অ্যান্ড টেইক স্ন্যাপ?

প্রশ্ন শুনে ভড়কে গেলাম একটু। শুনলাম কয়েক দিন আগেই কে যেন মারা গেছে বাঘের সঙ্গে ছবি তুলতে গিয়ে। ভয় পেলাম, কিন্তু ফেরত তো যাওয়া যায় না। মনে অনেক সাহস সঞ্চয় করে বললাম-

: মিষ

এবার মহিলাটির পাশে দাঁড়ানো একটি স্থানীয় পুরুষ আমার বাঁ হাতের পৃষ্ঠদেশে সিল মেরে দিল। সম্ভবত সেটা বাঘের সঙ্গে আমি যে স্বেচ্ছায় মুখোমুখি হতে রাজি হয়েছি তার সম্মতিপত্র। এবার বাঘের রাখাল অর্থাৎ কেয়ারটেকার এসে আমার হাত ধরে ঘেরাও করা জায়গার ভেতরে নিয়ে গেল। প্রেটি এলো সঙ্গে সঙ্গে।

ইয়া বড় রয়াল বেঙ্গল টাইগার! মুখ ব্যাদান করতেই তার দুপাশের তীক্ষ্ণ দাঁত ধারালো ড্যাগারের ফলার মতো বেরিয়ে পড়েছে। বাঘ দেখেই আমার সব সাহস উবে গেল। আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড়। কেমন নার্ভাস হয়ে গেলাম। বাঘের গলায় পোষা কুকুরের মতো বেল্ট পরানো। রাখাল সেটা ধরে রেখেছে। সে আমাকে বাঘের গলা জড়িয়ে ধরতে বলল। কিন্তু সাহস হলো না। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। বলা তো যায় না বন্যপ্রাণী কখন হিংস্র হয়ে উঠে। একটু আগেই তো এ ব্যাপারে বন্ড দিয়ে এসেছি। আবারও হাত ধরে টানল সে। আমি অনেক সাহস করে আলতোভাবে জানোয়ারটার গায়ে হাত রাখলাম। বারবার বাঘের হাতে এক হতভাগ্যের প্রাণ হারানোর কথা মনে হতে লাগল। আমার অনীহা দেখে লোকটি প্রেটিকে ডাকল। প্রেটি মহাখুশি। সে বাঘের মাথার পাশে বসে পড়ল। আমি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম

: ধরিস না, প্রেটি ধরিস না। সাবধান!

যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়। দুর্ঘটনা তো জীবনে একবারই হয়। যদি জন্তুটা হঠাৎ হিংস্র হয়ে আক্রমণ করে বসে! বলা তো যায় না। আমার চেঁচানো বৃথা। কে শোনে কার কথা। প্রেটি অবলীলায় বাঘটির মাথা কোলে তুলে নিয়ে হেসে পোজ দিল। ক্যামেরা ক্লিক করে উঠল লোকটির হাতে। প্রেটি তার নিকন ক্যামেরা আগেই দিয়ে রেখেছিল লোকটিকে। এবার আমার সাহস বাড়ল। আমিও এ ভয়ংকর জীবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে ফটো তুললাম। আরো দু-তিনটি ছবি তোলার পর বাঘের সঙ্গ ছাড়লাম আমরা। এতক্ষণে ভালো করে দেখলাম অধিকাংশ বাঘই লম্বা শক্ত লোহার শিকল দিয়ে মাটির সঙ্গে গরুর মতো খোটা গেড়ে আটকানো। যে গিরিখাতে আমরা আছি তার শেষ মাথা দিয়েও ঢোকা যায়। সেখানে একটি টিনের চলা ঘরের নিচে তীরচিহ্ন দিয়ে লেখা

: এন্ট্রেন্স এবং এক্সজিট। বেশ কিছু লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে স্থানটায়। এর সঙ্গেই আছে অ্যানিম্যাল রেস্কিউ সেন্টার।

এবার এলাম বাঘের গুহায়। অনেক বাঘ আছে টাইগার্স ডেনে। দেখি একজন মহারাজ গা এলিয়ে আরাম করছেন। আমার এখন সাহস বেড়ে গেছে। আমিও তার পাশে প্রায় গা এলিয়ে ছবি তুললাম। প্রতিটি বাঘের সঙ্গে একজন ট্রেইনার, কেয়ারটেকার বা রাখাল। আর তাদের সহযোগিতায় সবখানেই কেউ না কেউ ছবি তুলছেন। সব বাঘই মোটামুটি শান্তশিষ্ট। হয়তো ড্র্যাগ দেওয়া কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা স্বীকার করে না। টাইগার টেম্পলে বহুবিধ কার্যক্রম আছে। টিকিট কেনার সময়ই একটা প্রচারপত্র দিয়েছে, তাতে লেখা এসব :

সকালের অনুষ্ঠান সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে শুরু। বাঘের সঙ্গে মেশার সুযোগ আছে এ সময়। তখন বাঘের বাচ্চাদের বোতলে করে দুধ খাওয়ানো হয়। তারপর তাদের গোসল করিয়ে মুরগি খেতে দেওয়া হয়। পৌনে ২টা থেকে ২টা পর্যন্ত আবার বাঘের বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানো হয়। ইচ্ছা করলে দর্শকরা এতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। দেড়টা থেকে ২টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত শাবকদের ব্যায়াম ও খেলাধুলা। ১টা ৩০ মিনিট থেকে বড় বাঘদের নিয়ে বিশেষ ফটোসেশন। আমরা বিকালে এসেছি, অতএব ফটোসেশনেই যোগ দিলাম। যত খুশি ছবি তোলা যায়। এটাতেই আগ্রহ আমাদের। বেশ কয়েকটি ছবি তোলার পর গিরিখাত দিয়ে কিছদূর ভেতরে এগিয়ে গেলাম। লোকজনের ভিড় লেগে আছে। কাব ওয়াটার ফল, সাইফ ওয়াটার ফল, পাইয়ু ওয়াটার ফল নামে তিনটি জলপ্রপাত আছে এখানে। এসব স্থানে বাঘরা খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা বা স্নান করে। এখানে সালা নামক স্থানে একটা বৌদ্ধমন্দিরও আছে। নাম দি গোল্ডেন জুবিলী বুদ্ধ ইমেজ। মন্দিরের বৌদ্ধমূর্তিটি সোনার। তা ছাড়া আছে বোধিবৃক্ষ, যার নিচে বসে বৌদ্ধ মহাজ্ঞান লাভ করেছিলেন।

বিকাল গড়িয়ে গেছে। কিছু পরেই সন্ধ্যা হবে। ছবি তোলা শেষ করে আমরা বেরিয়ে আসলাম। বের হওয়ার সময় সেই নরওয়ের শ্বেতাঙ্গিনী বাঘের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার দুঃসাহসিকতার স্মারক হিসেবে আমাকে ও প্রেটিকে ব্যাঘ্র-দন্তের মেডেল উপহার দিলেন গলায় ঝুলিয়ে রাখার জন্য।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close