এম খান

  ১৮ জুলাই, ২০২১

পায়রা পাড়ের ঘর

দিনের শুরুটাই যেন এক অন্য রকম রৌদ্রকোজ্জ্বল। পথঘাট তাতানো কড়াইয়ের মতো ক্রুদ্ধ। বুরুজ উদ্দিন মোল্লার হাতে বাজারের ব্যাগ। মাসে একেকজন একেক দিন বাজার করবে। অর্থাৎ ১০ সদস্যের মেসে তিন দিন পরপর একেকজন বাজার করবে। এ সময়সূচি মাসের শেষ তারিখে শতভাগ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের উপস্থিতিতে নির্ধারণ করা হয়, কে কোন তারিখে বাজারে যাবে। গত পরশু রাতের বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ মাসে আজই বাজার করার শিডিউল বুরুজ উদ্দিন মোল্লার। মেসে দু-একজন বাদে সবাই নিয়মিত বা অনিয়মিত উচ্চ শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। বুরুজ উদ্দিন মোল্লাকে তার উত্তম কৃতকর্ম ও করিতকর্মার জন্য সবাই খুবই সমীহ করে। এ ছাড়া সবাই তাকে বংশীয় মর্যাদায় ‘মোল্লা’ বলে সম্বোধন করে; তাতে সে কিছুটা হলেও পুলকিত বোধ করে। দিন-রাত টিউশনি করে লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংসারিক খরচও জোগান দেয় বুরুজ উদ্দিন মোল্লা। সকালে তিনটা টিউশনি সেরে বাজারে যেতে যেতে প্রায় দুপুর। সবজি থেকে শুরু করে কোনো কিছুই ঠিকমতো পাওয়া যায় না তখন। তবু দুপুরবেলায়ই যেতে হয় তাকে, কারণ বিকালে সময়ের বেশি অভাব। টিউশনির সংখ্যা আগের চেয়ে ঢের বেশি। মোল্লা অঙ্কে এমএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সায়েন্সে গ্র্যাজুয়েট করার পরপরই পানিগ্রহণ করেন একমাত্র মামাত বোন পমরাকে। কিন্তু গ্র্যাজুয়েট সনদে কোনো চাকরি জোগাতে পারেননি । চাকরি না হলে কী হবে, মেস ও সংসারের খরচপাতি তো একটা আছে। এদের মেস বলতে এক-দেড়টা কক্ষ নিয়ে আটোসাটো বদ্ধ জীবন নয়, তাতে দুটি ১২ বাই ১৪, একটি ১০ বাই ১০ কক্ষ, একটি কিচেন, একটি বড় বাথরুম একটি ২০ বাই ২০ উঠোন বিশিষ্ট ছাপরা টিন শেডের সম্পূর্ণ একটি বাড়ি। বাড়ির প্রধান ফটকে পশ্চিম ও পূর্বদিকে মালতী, পলাশ ও চাঁপার ভিন্ন আবহ। উঠোনের চতুঃসীমাটা মালতী, পলাশ ও চাঁপার সঙ্গে লতাপাতায় ঘেরা বর্ণিল ছায়ার ছাউনি। আশপাশের কেউ ভাবতেই পারবে না এটি মেস না ফ্যামিলি বাড়ি। প্রতিদিন সকালে এক বৃদ্ধা তার ষোড়শী নাতনিকে নিয়ে ঝরে পড়া ফুল কুড়াতে আসেন। মেসের একজন তাদের ফুল কুড়াতে সহযোগিতা করেন। মোল্লা মেসে ওঠার পর একজনকে মুঠোফোনে বলতে শুনেছেন, ‘নিশি যতই গভীর নিদ্রা ততই আড়ালে, স্বপ্ন যখন আঁকে নিদ্রা তখন জমে, নিশিগন্ধা যখন মূর্তমান, যৌবন তখনই নিস্তব্ধ’। কথাগুলো শুনেও না শোনার বান ধরেন তিনি। ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় তরতর করে শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। ছাতা না নিয়ে এসে কী বোকামিটাই না হয়ে গেছে। একা একা এসব ভাবতে ভাবতে চলছে তার পথচলা। চারপাশে কত সুন্দর সুন্দর মাল্টিকালারের বাড়ি। দোতলা তেতলা থেকে দ্রুতগতিতে ১৫-২০ তলা উঠছে। মাগার, ঢাকা শহরের মানুষের এত টাকা হয় কী করে? নাহ্?, আমাকে দিয়ে আর কিছু হবে না।

টিউশনি ফিউশনি করে কি আর জায়গা জমি কেনা যাবে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মোল্লা। হঠাৎ দুর্গেশরূপী এক আধাখেঁচড়া তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ধুলোবালিতে জটপাকানো মাথার চুল। পরনে আধ ময়লা মার্কিন সাদা কাপড়ের লুঙ্গি। দুহাতে লোহার বালা। গলায় তিন প্যাঁচ দেওয়া শিকল। কাঁধে কবিয়ালি চটের ব্যাগ। উদ্যম লোকটি তার দিকে তীক্ষèদৃষ্টিতে তাকায়। তিনি ভয় পেয়ে পিছু হটতে থাকে। তখন লোকটি গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে, ভয় নাই। তোর কোনো ভয় নাই। এই শহরে তোরও একটা বাড়ি হবে। এটাই তো তুই চাস, তাই না?

মোল্লা তার প্রতি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ , বাবা... । আমি... বাকিটুকু আটকে থাকে তার দাঁত ও ঠোঁটে।

লোকটি বলল, থাক আর আমারে কইতে অইব না। হুদা একটা বাড়ি হবে না। এই শহরে তোর তিনটা বাড়ি হবে, পায়রার পাড়ে ছাওয়া পোয়া নিয়া তোর বিবিকে আর কষ্ট করতে অইব না, তোর কষ্টের কথা আমি জানি, বলব?

মোল্লার ক্ষত হৃদয়ে ভালো লাগার শীতল প্রবাহ বইতে শুরু করে। খুশিতে তিনি কম্পিত গলায় বললেন, তিনটা বাড়ি হবে? তিনটা বাড়ি দিয়ে আমি কী করব? আমার একটা হলেই হবে। লোকটি বলল, একটা তো হবে না বাপ? তিন রহস্যময় বিজোড় সংখ্যা। ত্রিকাল অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। স্বর্গ, মর্ত, পাতাল আবার ত্রিপদী, ত্রিবেণি, ত্রিশঙ্কু। তিন সংখ্যাটা মনে রাখিস। হে... হে... হে... ! অতঃপর লোকটি মাথাটা অদ্ভুতভাবে এদিক-ওদিক দুলিয়ে-দুলিয়ে হাসতে থাকে। তিনি চলে যাবেন কি না ভাবেন। লোকটি হাসি থামিয়ে জোর আওয়াজে বলে, দে, আমাকে টাহা দে।

তিনি পকেট থেকে ৫০ টাকার একটি নোট বের করে লোকটির হাতে দিলেন। লোকটি টাকাটা নেড়েচেড়ে দেখে বলল, পকেটে যা আছে সব দিয়ে দে। মোল্লা কর্তব্যবিমূঢ়তায় দাঁড়িয়ে থাকে। পাগলাটে লোকটি তার জটপাকানো দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, কী ভাবছস? যা আছে সব দিয়ে দে। আমি ফিন্দনের একটা ভবন কিনমু। মোল্লা পকেট থেকে ১০০ টাকার একটা নোট বের করে লোকটির হাতে দিলেন। লোকটি টাকাটার এপিঠ-ওপিঠ দেখতে দেখতে বলল, তরে না কইলাম যা আছে সব দিয়ে দিতে! এত চিন্তাভাবনা করস কেন? তোর অনেক ধন-সম্পদ হবে।

মোল্লা কিছুক্ষণ ইতস্তত হয়ে ভাবে। টাকাটা কি তার দিয়ে দেওয়া উচিত? ইত্যকার পাগল মানুষ... ঠকবাজ নাও হতে পারে, ভূতভবিষ্যৎ বিবেচনায় পকেটে যা ছিল সব টাকা হাতে নিয়ে দিতে গেলে লোকটা হ্যাঁচকা মেরে নিয়ে যায়। লোকটি বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে বলতে চলে যায়। বুরুজ উদ্দিন মোল্লা সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবে, বছরখানেক আগে তার এক বন্ধুর ভগ্নিপতি রংপুর থেকে নরসিংদী আসার পথে মলম পার্টি দিবালোকে অজ্ঞান করে ২৫ হাজার টাকা নিয়ে যায়। শেষে ড্রাইভার-হেলপার মিলে তাকে অসচেতন অবস্থায় গাউছিয়ার কাছাকাছি ফেলে চলে যায়। পরে বহু কষ্টে তার জীবন বেঁচে যায়।

মোল্লার এখন বাজারে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না। কারণ পকেটে একটা ফুটো পয়সাও নেই। মেসে শূন্য ব্যাগ নিয়ে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেই তার বুকের মধ্যে যেন একটা মনশ্চক্ষু জাগ্রত হয়েছে। হার্টবিট বেড়ে যায়। বুয়া (জোসনার মা) ১০ সদস্যের পরিবারের রান্না করার জন্য হয়তো তৈরি হয়ে আছে। তিনি বাজার নিয়ে ফিরলে কেটেকুটে রান্না চড়িয়ে দেবে। কিন্তু যখন দেখবেন খালি ব্যাগ নিয়ে ফিরেছে, তখন জোসনার মা রেগে গিয়ে কী করবে, কে জানে!

শেষ পর্যন্ত জোসনার মা সব শুনে রেগে বলল, পাগল বলল তোমার তিনটা বাড়ি হবে, আর তুমি সব টাকা দিয়ে দিলে? ওই ব্যাটা তো পাগল না। চিটিংবাজ। পাগল হলে তুমি। শুধু পাগল না। চ্যাম্পিয়ন পাগল।

কয়েক বছর পর। বুরুজ উদ্দিন মোল্লা টিউশনি নামক ভ্রাম্যমাণ পেশার ওপর হঠাৎ তার সরল মনটি ইউটার্ন হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীরা যোগাযোগ করলে বলে, ‘অনাত্মীয়কে আত্মীয় করো, কোনো দিন মানুষকে করো না অসম্মান’। তার সহাধ্যায়ী একজন সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করে দেখে নিজেও মেসের কাছাকাছি একটা নিটওয়্যারের গার্মেন্টে চাকরি শুরু করেন। এরপর এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট এবং সিঅ্যান্ডএফ। তরতর করে বাড়ে তার কর্মযজ্ঞের সফলতা। শহরের অভিজাত এলাকায় নিজেদের জন্য একটা বাড়ি ক্রয় করেন। পায়রার পাড় থেকে বিবি-বাচ্চাদের নতুন বাসায় নিয়ে আসেন। আরো দুটি বাড়ি কিনে ভাড়া দিয়ে রাখেন। মেসে ওঠার আগেই সে বিয়ে করে কত চড়াই-উতরাই করে তার জীবনের উত্থান। ওদের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে । সাগর ও উর্মি। ওরাও বাবা-মায়ের চড়াই-উতরাইয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড় হয়ে গেছে। পিঠাপিঠি দুই ভাইবোন। তাই একই স্কুলে একজন নবম শ্রেণিতে অন্যজন দশম শ্রেণিতে পড়ছে। সকাল ৭টা বাজতে না বাজতেই ভীষণ ব্যস্ততা পরমার। কাজের মেয়ে থাকলেও রান্নার কাজটা নিজেই করে। সকাল ৮টার মধ্যেই মোল্লা অফিসে চলে যায়।

সকাল ৮টার পরেই পুরো বাসাটা ফাঁকা। সুনসান নিস্তব্ধ নীরবতা। আসলে ছেলেমেয়ে দুটোই বাসাটাকে একদম মাতিয়ে রাখে। ক্যাসেট প্লেয়ার ছেড়ে এই গান শুনছে তো ওই নাচ প্র্যাকটিস করছে আবার সুযোগ পেলে দুজনেই মায়ের মোবাইলে গেম প্লেইং। কখনো আবার দুজনে মিলে তুমুল তর্কজুড়ে দিচ্ছে। তর্ক ধাঁধার বিষয়েরও কোনো অভাব নেই। মোল্লা রেডি হয়ে এসে খাবার টেবিলে বসতে বসতে বলল, ওরা রেডি হয়েছে?

: পরমা প্লেটে নাশতা সাজিয়ে দিতে দিতে বলল, হ্যাঁ, ওরা রেডি হচ্ছে। তুমি খেতে শুরু করো। একটু তাড়াতাড়ি করতে বল। পরমা ডাইনিং রুম থেকেই উঁচু গলায় বলল, সাগর-উর্মি, তোদের হলো?

: উর্মি ওদের রিডিং রুম থেকে সাড়া দিল এইতো মা, আমরা রেডি ।

: মোল্লা রুটি চিলতে করে গরম দুধে ভিজিয়ে খাচ্ছেন। এটাই তার প্রতিদিনের ব্রেকফাস্ট। যখন টিউশনি করে মেসে থেকে সংসার চালাত, তখনো মেসে ওই খাবারই খেত, এখন অবস্থার পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও খান। সাগর ও উর্মি এসে বাবার দুপাশে বসে বলল, গুড মর্নিং বাবা!

: গুড মর্নিং!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close