বাদল চৌধুরী

  ১৮ জুলাই, ২০২১

শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকে তার নির্দেশে এই ভূখণ্ডে শুরু হয় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন। ৮ মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ করে দেয়। কেবল অত্যাবশ্যকীয় সেবাদানমূলক প্রতিষ্ঠান : ব্যাংক, বিমা, পানি, বিদ্যুৎ, হাসপাতাল, মিউনিসিপ্যালিটি, মেডিকেল ক্লিনিক খোলা রাখা হয়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করায় পুলিশ বাহিনী ও ইপিআরের বাঙালি সদস্যের অনেক পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপকে সমর্থন করেছিলেন এবং সে সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, শিক্ষক-প্রকৌশলী, আইনজীবী ও পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর লোকজন, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র সংগঠন বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে তার অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ ও দ্ব্যর্থহীন সমর্থন এবং একাত্মতা প্রকাশ করতে থাকেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের বিভীষিকাময় রাতে শেখ হাসিনা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন সাত মসজিদ রোডের এক বাসায়। এই রাতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এ সময় তার মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলকে নিয়ে দেয়াল টপকে পাশের বাসায় আত্মগোপন করেছিলেন। অবশ্য শেখ কামাল আগে থেকেই ৩২ নম্বর থেকে অন্যত্র সরে যান। কেননা, ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই বিপদের আশঙ্কা করছিলেন সবাই।

খাবার টেবিলে বসে এক দিন বঙ্গবন্ধু বাড়ির সবাইকে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে মানসিকভাবে তৈরি থাকতেও বলেছিলেন। এজন্য দুবেলা সবাইকে নিয়ে তিনি খেতে বসতেন। ১৮ মার্চের পর পরিস্থিতি যখন আরো জটিল হয়ে উঠল, তখন শেখ মুজিব-ই ড. ওয়াজেদকে পৃথক বাসায় হাসিনাকে নিয়ে উঠতে বললেন। শেখ হাসিনা তখন প্রথম মা হতে চলেছেন। স্বামী ড. আবদুল ওয়াজেদ মিয়া খুঁজে খুঁজে হাতিরপুল ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটি বাড়ির নিচতলা ভাড়া নেন এবং ঠেলাগাড়ি ঠিক করে ওই বাসায় মালামালও নিয়ে আসেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে ওই বাসায় উঠেননি। তারা ৩২ নম্বরেই রয়ে গেলেন। ২১ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু ড. ওয়াজেদকে আবারও বলেন, তোমরা ৩২ নম্বর থেকে সরে যাও।

এরপর ড. আবদুল ওয়াজেদ মিয়া সাত মসজিদ রোডে একটি বাসা ভাড়া নেন। ২৫ মার্চ রাত ১২টায় পাকিস্তানি সৈন্যদের হামলার কিছুক্ষণ আগে শেখ হাসিনা চলে আসেন ওই বাসায়। সঙ্গে করে নিয়ে আসেন শেখ রেহানা এবং শেখ শহীদের ছোট বোন শেখ জলিকে। ড. ওয়াজেদ এর আধঘণ্টা আগে কাজের ছেলে পাগলাকে নিয়ে ওই বাসায় আসেন। ৩২ নম্বরের বাড়ি সারা দিন জমজমাট ছিল; কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে ফাঁকা হতে শুরু করেছিল। ২৭ মার্চ কারফিউর বিরতির সুযোগে শেখ হাসিনা পাঠালেন স্বামী ড. ওয়াজেদকে ৩২ নম্বরের খোঁজখবর নিতে। ড. ওয়াজেদ বেরোনোর আগে শেখ হাসিনার বাসার দেয়াল টপকে একটি ছেলে অবশ্য জানিয়ে যায়, শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাসার অন্যদের কী অবস্থা, এটা জানার জন্য ড. ওয়াজেদ ৩২ নম্বরের কাছে যান এবং পাশের এক বাসা থেকে জানতে পারেন, তার শাশুড়ি শেখ হাসিনার বাসার উদ্দেশেই রওনা হয়েছেন। ড. ওয়াজেদ সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসেন বাসায় এবং এখানে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে তিনি যোগাযোগ করেন মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় তার বন্ধু ড. মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে। কিন্তু তার বন্ধুর বাসায় একটিমাত্র কক্ষ খালি ছিল। তাই তারা দুটি ভাগে ভাগ হলেন। শেখ মুজিবের ফুফাতো ভাই মোমিনুল হক খোকা; বেগম মুজিব, শেখ রেহানা, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলকে নিয়ে চলে যান ওয়ারীতে তার শ্বশুরবাড়ি। ড. ওয়াজেদ শেখ হাসিনা ও জলিকে নিয়ে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার ঝিলের কাছে বন্ধুর বাসায় গিয়ে উঠেন।

১ এপ্রিল থেকে খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার গোলচত্বরে ঢোকার প্রধান পথের কাছে ড. ওয়াজেদ মিয়া ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আণবিক শক্তি কেন্দ্র, ঢাকা এই নামে একটি বাড়ির ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া হয়। সেই ফ্ল্যাটে তার শাশুড়ি, শেখ হাসিনা, জামাল, রেহানা, রাসেল, জলি, মোমিনুল হক খোকা এবং তার স্ত্রী, দুই সন্তাসহ সবাই গিয়ে উঠেন। এই ফ্ল্যাট থেকেই দেখা যেত আর্মিরা রাস্তায় টহল দিচ্ছে এবং বিভিন্ন ঘোষণা দিচ্ছে। ভয়ে ভয়ে ৫-৬ দিন কোনো রকমে ওই বাসায় কেটে গেল; কিন্তু হঠাৎ বিপত্তি ঘটালেন ওই বাসার বাড়িওয়ালি। তিনি এসে বেগম মুজিবকে বাড়িভাড়া ফেরত দিয়ে বললেন, আপনাদের পরিচয় জানাজানি হয়ে গেছে। আল্লাহর দোহাই, আপনারা দয়া করে এই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তা না হলে পাকিস্তানি আর্মিরা আমাদের এই বাড়িটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবে।

ওই বাসায় থাকতেই শেখ কামাল এক দিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বেগম মুজিবকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘মা, আমি আজ রাতে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তোমরা আল্লাহর কাছে আমার জন্য দোয়া করো।’ এদিকে উপায়ন্তর না দেখে বেগম বদরুন্নেসার স্বামী নূর উদ্দিন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি তার মগবাজারের চৌরাস্তার কাছে প্রধান সড়কে অবস্থিত বাড়ির নিচতলায় তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। ওই বাসায় থাকার সময় এক দিন পত্রিকায় দেখা গেল পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দুজন কর্মকর্তা প্রহরারত অবস্থায় করাচি বিমানবন্দরের লাউঞ্জে তোলা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছবি, যা সরকারের নির্দেশে প্রকাশ করা হয়।

তখন প্রায়ই বৃষ্টি হতো এবং প্রায় প্রতি সন্ধ্যায়ই কিছুসংখ্যক অচেনা পশ্চিম পাকিস্তানি লোককে সেখানে ঘোরাফেরা করতে দেখা যেত। কোনো কোনো রাতে পাকিস্তান আর্মির ট্রাক বাড়িটির সামনে এসে থামত। যার জন্য বেগম মুজিব কিছুতেই দুচোখের পাতা এক করতে পারতেন না। তাই তিনি জামাইকে বললেন, মহল্লার ভেতরের গলির দিকে একটি দোতলা বাড়ির ওপরতলা ভাড়া নিতে। বেশি ভেতরের গলিতে বাসা খালি না পেয়ে ওই বাসার কাছাকাছি একটি বাড়ির দোতলা ফ্ল্যাট ভাড়া নেন ড. ওয়াজেদ। ওই বাসায় কেটে যায় প্রায় ১৫ দিন। এরই মধ্যে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী এসে জানান, ১০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা শেখ মুজিবের নামে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের কাছে আম্রকাননে এই রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়।

১৯৭১ সালের ১২ মের ঘটনা। সেদিন বিকালে একজন পাকিস্তানি দোতলায় উঠে আসেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ড. ওয়াজেদ বারান্দায় তার সঙ্গে কথা বলতে যান। আগন্তুক নিজেকে পাকিস্তান আর্মির লোক বলে পরিচয় দেন এবং বলেন, এই বাসায় শেখ মুজিবের পরিবার আছে। আমি সরকারি নির্দেশে আপনাদের গ্রেপ্তার করতে এসেছি। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে কি না জানতে চাইলে মেজর হোসেন বলেন, তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এমন এক বিভাগের কর্মকর্তা, যার বিনা পরোয়ানায়, যেকোনো ব্যক্তিকে যেকোনো অবস্থায় গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা রয়েছে। তিনি সেখানে বসেই ওয়ারলেসে সংবাদ পাঠিয়ে আরো একটি সশস্ত্র সৈন্যসহ জিপ ও আর্মি ট্রাক আনালেন। প্রায় সন্ধ্যার দিকে কড়া প্রহরায় সেনাবহরটি বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারকে তৎকালীন ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমানে শেরাটন) বহির্গমন গেটের পেছন দিকে নিয়ে রাখে। অতঃপর ধানমন্ডির পুরাতন ১৮ নম্বর (নতুন ৯/এ) সড়কের ২৬ নম্বর বাড়িতে সশস্ত্র সৈন্যকে পাহারায় রেখে মেজর হোসেন চলে যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বেগম মুজিব অজ্ঞান হয়ে পড়েন। সে রাতে তাদের অনাহারেই কাটাতে হয়। কারণ, কারফিউ বলবৎ ছিল এবং আশপাশে কোনো দোকানপাটও ছিল না। ২৬ নম্বরের বাড়িটি ছিল একতলা। ধানমন্ডি স্কুলের কাছাকাছি। ওই বাড়িতে কোনো আসবাবপত্রও ছিল না। ওই বাড়ির পরিবেশও ছিল একেবারে গুমোট। চারপাশ ছিল আবর্জনায় ভরা এবং প্রধান দরজাটিও ছিল ভাঙা। জানালার কাচও ছিল একেবারে ভাঙাচোরা। ড. ওয়াজেদ ও শেখ হাসিনাসহ সবাইকে ফ্লোরে থাকতে হতো চাদর বিছিয়ে। প্রায় দুদিন তাদের তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। ২০ জনের সৈন্যদলটি বাসা পাহারা দেয়। মেজর হোসেন বাসা ছেড়ে যাওয়ার সময় বলে যায়, কেউ বের হতে পারবে না এবং সরকার আপনাদের পরিবারের খাওয়া-দাওয়ার জন্য টাকা দেবে। কিন্তু বেগম মুজিব ও শেখ হাসিনা বললেন, সরকারের টাকার দরকার নেই। ড. ওয়াজেদকে বেতন দিলেই চলবে। পরে এ ব্যবস্থাই বলবৎ হলো। ড. ওয়াজেদ নিয়মিত অফিস করতেন এবং যে বেতন পেতেন তা দিয়ে মোটামুটি সবার খরচ হয়ে যেত।

বাসায় একটি কাজের ছেলে ছিল। সে বাজার করত। এভাবেই কেটে গেল মে-জুন মাস। বাসায় ডিউটিরত সেনারা রাতে জানালার পাশে বেয়নেট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। তখন দেশে পুরোদমে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। গুলির আওয়াজ পাওয়া গেলেই ডিউটিরত হাবিলদাররা স্টেনগ্যান নিয়ে এসে ঘরের ভেতর ঢুকত। ভয়ে বাসার কেউই কখনো ঘুমাতে পারতেন না। এমনি করেই জুলাই মাস এসে যায়। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় প্রচন্ড মানসিক চাপে ভুগতেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার ডেলিভারির সময় ঘনিয়ে আসে। পাকসেনারা কিছুতেই শেখ হাসিনাকে ডাক্তারের কাছে যেতে দিতে চায় না। অনেক অনুরোধের পর শেষে ডাক্তার ওদুদকে দেখানোর অনুমতি পাওয়া গেল। কিন্তু কড়া আর্মি গার্ড দিয়ে ডাক্তার ওদুদের বাসায় যেতে হলো।

২০ জুলাই শেখ হাসিনাকে ঢাকা মেডিকেলের একটি কেবিনে ভর্তি করা হলো। ২৭ জুলাই রাত ৮টায় তাকে লেবার ওয়ার্ডে নেওয়া হলো। নির্ধারিত সময়ের এক মাস আগেই তাদের সন্তান জন্ম নেয়। হাসপাতালে শেখ হাসিনার সঙ্গে রাতে ড. ওয়াজেদ থাকতেন। পরে অবশ্য খবর পেয়ে অনেক আত্মীয়স্বজন দেখতে আসতেন। শেখ হাসিনাকে দেখাশোনার জন্য বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন লিলি থাকলেন। কয়েক দিনের মধ্যেই পাকসেনারা এসে সবাইকে ধমকিয়ে বের করে দেয়। পাকসেনারা লিলি ফুফুকে বের করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা প্রচ- কান্নাকাটি শুরু করায় অবশেষে তাকে থাকতে অনুমতি দেওয়া হলো। কয়েক দিনের মধ্যে শেখ হাসিনা এবং ছেলেকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসেন। বেগম মুজিব নাতিকে দেখে অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি বললেন, ‘আমার তো ভাই নেই, তাই ওর নাম রাখলাম সজীব। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্মেছে, তাই ডাকনাম রাখলাম জয়। মুজিবের সঙ্গে মানাবে ভালো।’ শেখ হাসিনা মায়ের কথা শোনে খুশি হলেনÑ তিনি বললেন, আব্বাও আমাকে এক দিন বলেছিলেন, ছেলে হলে নাম রাখতে ‘জয়’। ‘জয় বাংলার জয়’। আর মেয়ে হলে জয়া নাম রাখতে। শেখ হাসিনার ছেলের নাম জয় রাখা হলো কেন, এ নিয়েও পাকসেনারা বিভিন্নভাবে কটাক্ষ করেছে। নভেম্বরের দিকে ড. ওয়াজেদ দেখেন ওরা বাংকার খুঁড়ছে। শেখ হাসিনা তাকে বললেন, সম্ভবত ওরা আমাদের মেরে ওখানে পুঁতে রাখার জন্যই এই ব্যবস্থা করছে। ড. ওয়াজেদ বাইরে থাকলে হয়তো পাকসেনারা মুজিব পরিবারকে হত্যা করতে সাহস পাবে না।

৪ ডিসেম্বর (১৯৭১) মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দুজনের যুগ্ম দস্তখতে চিঠি লেখা হয়েছিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে। চিঠির মূল বক্তব্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান। তখন সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সর্বাধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীনে ভারতীয় পূর্ব ফ্রন্টের সামরিক বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে ‘ভারত-বাংলাদেশ মিত্রবাহিনী’ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ৭ ডিসেম্বর ভুটান সরকারও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে সাহায্য ও সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে। ইতোমধ্যে ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশন ও আন্তর্জাতিক সংস্থার লোকজন এবং বিদেশি সাংবাদিক ঢাকায় অবস্থিত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ৭ ডিসেম্বর রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার ও অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিদেশি প্রচারমাধ্যমগুলো যেমন অস্ট্রেলিয়ান বেতার কেন্দ্র, ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের প্রচার কেন্দ্র, ভয়েস অব আমেরিকার প্রচার কেন্দ্র থেকে পাকিস্তানিদের যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতনের খবর শুনতে পাওয়া যায়। ১০ ডিসেম্বর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রণাঙ্গনে পর্যুদস্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সৈন্যরা ঢাকায় আসতে শুরু করে।

১৩ ডিসেম্বর সকালে রেডিও পাকিস্তানে ঢাকার অনুষ্ঠান শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যে আবার বন্ধ হয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনটি ভারতীয় বিমান একযোগে গভর্নর হাউসে (বঙ্গভবন) রকেট সেল নিক্ষেপ করে প্রায় আধঘণ্টা ধরে। ওই দিনই পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্দেশে পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক (বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক) থেকে সব টাকা-পয়সা, স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা লুণ্ঠন এবং ব্যাংক চত্বরে বস্তায় বস্তায় কাগজের নোট পোড়ানো হয়। এ ছাড়াও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর লোকেরা সরকারি বাসগুলো ধ্বংস এবং সেগুলোর যন্ত্রপাতি লুণ্ঠন করা ছাড়াও এ দেশের সাংবাদিক-কবি-সাহিত্যিক-ডাক্তার-উকিল-প্রকৌশলী ধরে ধরে রাতের অন্ধকারে হত্যা করতে থাকে। অনেক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি, রেকর্ডপত্র বিনষ্ট করে। এমনকি ১৬ ডিসেম্বরের প্রাক্কালে কারফিউ জারি থাকা অবস্থায় দিনের বেলা এরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যায়।

১৫ ডিসেম্বর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দুটো ভারতীয় বিমান সারা ঢাকা শহরে লিফলেট ছড়িয়ে দেয়। ভারতীয় আর্মি চিফ অব স্টাফ ও মিত্রবাহিনী প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশ-এর নামে প্রচারিত উক্ত লিফলেট পূর্ব পাকিস্তানের পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছিল, ‘অবিলম্বে আমার অগ্রগামী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে আপনাদের সৈন্যবাহিনী এবং অন্যান্য ব্যক্তির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। এর পরও যদি আমার আবেদন মোতাবেক আপনার পুরো সামরিক বাহিনীসহ আত্মসমর্পণ না করে, তাহলে ১৬ ডিসেম্বর সকাল নটার পর আমি মিত্রবাহিনীকে পূর্ণোদ্যমে আঘাত হানার নির্দেশ দিতে বাধ্য হব।’ উর্দু ও ইংরেজিতে জেনারেল মানেকশ-এর এই আহ্বান বাংলাদেশের সর্বত্র বিমানযোগে বিতরণ করা হয়েছিল। ওইদিন সন্ধ্যা হতে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকেও জেনারেল মানেকশ-এর কণ্ঠে টেপকৃত উক্ত আহ্বান কিছুক্ষণ পর পর প্রচার করা হয়েছিল। উক্ত আহ্বানে আরো বলা হয়েছিল, ‘পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় ১৫ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১৬ তারিখ সকাল ৯টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান হামলা বন্ধ রাখা হবে।’

১৬ ডিসেম্বর বেলা ২টার দিকে তিনটি ভারতীয় সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান মেজর জেনারেল জ্যাকর তার কয়েকজন উচ্চপদস্থ সহকর্মী নিয়ে ঢাকা পৌঁছান। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সামরিক বাহিনীর ৮-১০টি হেলিকপ্টারে করে ভারতীয় ইস্টার্ন সেক্টরের সামরিক বাহিনী ও মুক্তবাহিনীর যৌথ কমান্ডের সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগৎ জিত সিং অরোরো তার পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক সহকর্মী এবং মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকারকে নিয়ে ঢাকা পৌঁছান। পাকিস্তান ইস্টার্ন সামরিক কমান্ডের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এর সেই স্থানে, যেখানে মাত্র ৯ মাস ৯ দিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৬ ডিসেম্বর সকালের দিকে ঢাকার পথঘাট ছিল প্রায় জনশূন্য। কিন্তু ৩টার দিকে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে হাজার হাজার লোক পরাজিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান দেখার জন্য জমায়েত হয়। তখন চারদিকে শুধু গগনবিদারি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শোনা যেতে থাকল। বিকাল ৪টা ১৯ মিনিটের সময় পাকিস্তান সরকার ও তার সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের পক্ষে লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ভারত-বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন। হাজার হাজার জনতা ও শতাধিক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এই অনুষ্ঠানে অবলোকন করলেন এবং ঢাকা নগরীর প্রতিটি বাড়িতে তখন গাঢ় সবুজের ওপর লালবলয়ের মধ্যে সোনালি রঙের বাংলাদেশের মানচিত্রসংবলিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পত পত করে উড়ছিল।

ড. ওয়াজেদ বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লোক মারফত খবর নিয়ে জানতে পারি, তখনো ধানমন্ডির (পুরাতন) ১৮ নম্বর (নতুন ৯/এ নম্বর) রোডের ২৬ নম্বর বাড়িতে পাকিস্তানি আর্মির সৈন্যরা প্রহরারত রয়েছে এবং সেখানে বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা, রেহানা, রাসেল, জয় ও অন্যরা কী অবস্থায় রয়েছে, সে সম্পর্কে কেউই সঠিক তথ্য দিতে পারল না। পরদিন অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৮টার দিকে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর (১১ নম্বর) নতুন রোডের বাড়ির পশ্চিম পাশের বাসার শেরায়ে খান, ডা. এম এ সামাদ খান চৌধুরী ও তার মেজো ছেলে এ আহাদ খান চৌধুরী এবং এ কে এম মোশাররফ হোসেনসহ আমি একটি গাড়িতে করে ধানমন্ডি বালিকা বিদ্যালয়ে পশ্চিম পাশের পুরাতন ২০ নম্বর (নতুন ১২/এ) হয়ে ১৮ নম্বর রাস্তায় প্রবেশ করে ধীরে ধীরে ওই বাড়িটির দিকে অগ্রসর হই। বাড়িটির কাছে এগোনো মাত্রই সেখানকার একজন আর্মি গাড়িটির দিকে বন্দুক তাক করে আমাদের থামতে আদেশ করে। তখন বিপদের ঝুঁকি সত্ত্বেও আমি গাড়ি থেকে বেরিয়ে দুহাত উঁচু করে দাঁড়ালে সে আমাকে চিনতে পারে এবং আমাদের গাড়িটিকে বাড়িটির গেটের দিকে নিতে বলে। সেখানে পৌঁছে বাড়িটির ভেতরে লোকজনের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সেখানে অবস্থানরত দুজন সৈন্যকে পরে আসব বলে দ্রুত সেখান থেকে চলে আসি।’

১৬ ডিসেম্বর অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা, রক্তক্ষয়, হাজারো মা-বোনের ইজ্জত এবং লাখো প্রাণের বিনিময়ে সেদিন এভাবেই এ দেশের মাটি থেকে শত্রু উৎখাত হয়েছিল। বীরের জাতি বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে সাড়া দিয়ে যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর অস্ত্রের মুখে মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এ দেশকে স্বাধীন করবে বলে, মুক্ত করবে বলে। তাই আজ আমরা গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ১৭ ডিসেম্বর সম্মিলিত বাহিনী এসে পাকবাহিনীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় এবং সেই সঙ্গে মুক্তি পান বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close