মাসউদুল কাদির
অপূর্ব প্রেমময়তায় কোরবানি বন্দনা
কোরবানি একটি ত্যাগের নাম। মহান আল্লাহর ভালোবাসায় নিজেকে লিন করার অপূর্ব এক প্রেমময় দ্যুতনার নাম কোরবানি। তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশই কোরবানির মৌলিক আবেদন। আরবি ভাষায় কোরবানি শব্দটির অর্থ নৈকট্য লাভ করা, সান্নিধ্য অর্জন করা, কাছাকাছি যাওয়া, সহবত লাভ করা ইত্যাদি। মৌলিকভাবে কোনো উদ্দেশ্যে, লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য যেকোনো উপায় অবলম্বন করাকে কোরবানি বলে। কেউ কেউ বলেছেন, কারো জন্য কোনো ত্যাগ করাই কোরবানি। শরিয়তের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয়, মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে হালাল কোনো পশু আল্লাহর নামে জবাই করা।
কোরবানির ইতিহাস : পৃথিবী শুরু হয়েছে হজরত আদম (আ.) থেকে। তার ছেলেদের দিয়েই মহান আল্লাহ কোরবানির মতো একটি অনন্য আমলের সূত্রপাত করেন। পৃথিবীতে আগত সব মানুষের জন্য রেখে গেছেন নীতি ও নৈতিকতার এক বিরল ইতিহাসও। হজরত আদমের দুই সন্তান হাবিল ও কাবিল ছিলেন কোরবানির উদ্দিষ্ট ব্যক্তিত্ব। ঘটনার মূল কেন্দ্রবিন্দ্র ছিল আজকের সমাজে পণ্য হয়ে ওঠা নারী। একজন সুন্দরী নারীর সংস্পর্শ পাওয়ার আগ্রহেই দুজন সন্তান বিবাদে জড়িয়ে যান। তখন হজরত আদমের এক জোড়া সন্তানের (ছেলে ও মেয়ে) সঙ্গে অপর জোড়া সন্তানের সঙ্গে (ছেলে ও মেয়ে) বিয়ে হতো। কাবিল এই বিধান অমান্য করলেই সমস্যা বেঁধে যায়। জাতির পিতা হজরত আদম আলাইহিস সালাম এ বিবাদ মেটানোর নিমিত্তে তাদের উভয়কেই দুম্বা কোরবানি দেওয়ার নির্দেশ করলেন। তিনি বললেন, ‘যার কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হবে, তার কোরবানি আকাশ থেকে আগুন এসে জ্বালিয়ে দেবে এবং তারই বিয়ে হবে।’
মহান আল্লাহ সব সময় সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চান। পৃথিবীর সূচনায়ও সত্যকেই জিতিয়ে দিলেন মহান আল্লাহ। পবিত্র কোরআনে কত নির্জলা ভাষায় মহান আল্লাহ ইরশাদ করছেন, ‘আদমের দুই ছেলের বৃত্তান্ত তুমি তাদের শোনাও। তখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো, অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। সে বলল, আমি তোমাকে হত্যা করবই, অন্যজন বলল, অবশ্যই আল্লাহতায়ালা মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা মায়িদা : ২৭)।
দায়িরাতুল মারিফের এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, হজরত নুহ আলাইহিস সালাম পশু জবাই দেওয়ার জন্য একটি কোরবানির জায়গা (কোরবানির মাঠ) তৈরি করেছিলেন। মাঠে তিনি জবাই করা পশু আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতেন।
কোরবানি উপলক্ষে হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম দিয়েছিলেন সবচেয়ে বড় ত্যাগ। কতটা বছর প্রভুর দরবারে চেয়ে শেষে হজরত ইসমাইলের মতো ফুটফুটে বালক মহান আল্লাহ তাকে দান করেছিলেন। এ বালককে দিয়েই তিনি আবার একটি বড় পরীক্ষা নিলেন। ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ছিলেন খলিলুল্লাহ। আল্লাহর বন্ধু। বন্ধুত্বের এত বড় পরীক্ষা দিতে হয় পৃথিবী হয়তো এর আগে জানতই না। হজরত ইব্রাহীম পরীক্ষা দিলেন, উত্তীর্ণ হলেন। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অবতীর্ণ পবিত্র কালামে মহান আল্লাহ খুব সাবলিলভাবে বর্ণনাটি করেছেন। ‘অতঃপর সে যখন তার বাবার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম তাকে বললেন, বৎস, আমি স্বপ্নে দেখি, তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কী বলো। সে বলল, পিতা আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন। আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম জবাই করার জন্য শায়িত করলেন। তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহিম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে, আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম জবাই করার জন্য এক মহান পশু।’ (সুরা আসসাফ্ফাত : ১০২-১০৭)।
কোরবানির গুরুত্ব : কোরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই মহান আল্লাহর দরবারে তা পৌঁছে যায়। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, কোরবানির দিন আল্লাহর কাছে রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে (কোরবানির চেয়ে) বনি আদমের জন্য অন্য কোনো আমল বেশি পছন্দনীয় নয়। কোরবানির পশু কিয়ামতের দিন তার শিং, পশম ও হাড়সহ আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে। আর কোরবানির পশুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা কোরবানি করে নিজেদের হৃদয়কে সন্তুষ্ট রাখো। (তিরিজিমি)
কোরবানির বিধান : কোরবানি দেওয়ার জন্য কিছু শর্তাবলি রয়েছে। ব্যক্তিকে মুসলমান হতে হবে, স্বাধীন হতে হবে, মুকিম হতে হবে ও সামর্থ্যবান হতে হবে। সুতরাং যিনি কাফের, দাস-দাসী, মুসাফির ও দরিদ্রদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। ফাতওয়ায়ে শামির উদ্ধৃতি দিয়ে ইসলামি ফিকাহ গবেষকরা বলেছেন, কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে, নেসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর অতিবাহিত হওয়া জরুরি নয়। দৈনন্দিন প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ ভরি রুপার মালিকানাকে নেসাব বলা হয়।
হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের আত্মত্যাগের এই জলজ্যান্ত ঘটনা মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করে জীবনে কোরবানির প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে কোরবানির প্রতি মানবজাতিকে উৎসাহিত করে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাউসার : ২)।
কোরবানির পশু নির্বাচন : ছাগল, দুম্বা, ভেড়া, গরু, মহিষ ও উটÑ এগুলো ছাড়া অন্য যত পশু দামেরই হোক তা দিয়ে কোরবানি হবে না। গরু, মহিষ, উটের কোনো একটি দিয়ে সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরবানি দেওয়া যাবে। আর ছাগল, ভেড়া, দুম্বা দিয়ে একজনের পক্ষেই কোরবানি দেওয়া যাবে। গরু ও মহিষের বয়স কমপক্ষে দুই বছর হতে হবে, উটের বয়স হতে হবে পাঁচ বছর আর অন্য পশুগুলোর বয়স কমপক্ষে এক বছর হতে হবে।
ঘোড়া, অন্ধ, রুগ্ণ, কৃশ ও দুর্বল পশু দিয়ে কোরবানি দেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। যে প্রাণী এতই দুর্বল ও রোগা হয় যে, এটি কোরবানির স্থলভূমি পর্যন্ত নিজে হেঁটে পৌঁছাতে সক্ষম নয়, তা দিয়ে কোরবানি জায়েজ নয়। দুররে মুখতারে আছে, যে প্রাণীর কান জন্মগতভাবে নেই, তার কোরবানি বৈধ নয়।
কোরবানির পরিবর্তে দান : সময়মতো কোরবানি করতে না পারলে কোরবানির পশুর সমপরিমাণ অর্থ দরিদ্রদের দান করা ওয়াজিব। তবে কোরবানির দিনগুলোয় কোনো দান-সদকা করলে হবে না। পৃথক বৈশিষ্ট্য রাখে এই কোরবানির আমল। নামাজ যেমন রোজা দিয়ে আদায় হয় না, তেমনি কোরবানিও অন্য কোনো উপায়ে আদায় হয় না। দান এক জিনিস আর কোরবানি আরেক জিনিস। কোরবানি একটি স্বতন্ত্র আমল। স্বাতন্ত্র্যিক বৈশিষ্ট্য রাখে এই কোরবানি।
কোরবানির সুন্নত পদ্ধতি : কোরবানি একজন জান্তা ব্যক্তিকে করতে হয়। নিজে কোরবানি করার নিয়ম না জানলে তখন কোনো জান্তা ব্যক্তির সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। চামড়া ব্যবসায় সহযোগিতা হয় বলে সুন্নতি পোশাকে পাড়ার মাস্তানরাও রূপ ধারণ করে। যে কাউকে দিয়ে কোরবানি করা উচিত নয়। জবাই করার সময় ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলা জরুরি। কোরবানির পশুকে কিবলামুখী করে শুইয়ে এই দোয়াটি পড়তে হয়Ñ ‘ইন্নি ওয়াজ্জাহতু ওয়াজ্হিয়া নিল্লাহি ফতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওমা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন্নি কামা তাকাব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মদি ওয়া খালিলিকা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম।’ এই দোয়াটি একটু পেছনে সরে পড়াটা ভালো।
কোরবানির গোশত ও চামড়া : কোরবানির গোশত বিক্রি করা হারাম। যিনি কোরবানির পশুর অর্থ ব্যয় করবেন, তিনিই কোরবানির পশুর গোশত ও হাড়ের মালিক। সব গোশত নিজে রেখে দিতে পারেন আবার সাধারণদের মধ্যে বণ্টনও করতে পারেন। তবে কোরবানির গোশত তিন ভাগ করতে হবে। এক. নিজের পরিবারের জন্য। দুই. আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব। এবং তিন. গরিব-অসহায় ব্যক্তিদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। কয়েকজন মিলে একসঙ্গে কোরবানি দিলে অবশ্যই অনুমান করে তা ভাগ করবে না। পাল্লায় মেপে ভাগ করতে হবে। অন্যথায় কোরবানি আল্লাহর কাছে গৃহীত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে।
ত্যাগের শিক্ষাই কোরবানি থেকে আমরা গ্রহণ করি। ত্যাগ ছাড়া মানুষের জীবন কখনোই সুন্দর হতে পারে না। হজরত ইসমাইলকে ত্যাগ করার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম পৃথিবীবাসীকে ত্যাগের শিক্ষাই দিয়েছেন।
"