জিহাদ হোসেন রাহাত
মুক্তমত
মেট্রোরেল কেন বিজ্ঞাপন ডিপো
হাজার কোটি টাকা ব্যয় আর কোটি মানুষের স্বপ্নের বাস্তব এক রূপের নাম মেট্রোরেল। যানজটের শহরে একপ্রকার জাদুর বাহন বলা যায় এটিকে। সড়কপথে বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় এটি সময় কমিয়েছে প্রায় দুই থেকে আড়াই গুণ। কম সময়ে রাজধানী শহর ঢাকার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াতে স্বস্তি ফিরেছে জনমনে। বর্তমান সরকারের উল্লেখযোগ্য সফলতার একটি হিসেবে মেট্রোরেল প্রকল্পকে ধরা হলেও বোধ করি ভুল হবে না। ব্যাপক প্রশংসিত মেট্রোরেল উদ্বোধনের বছর না পেরোতেই সেটি নিয়ে শুরু হয়েছে আকাশসম সমালোচনা। কেউ কেউ দেখাচ্ছেন চরম বিরক্তি। প্রশ্ন তুলছেন, ‘মেট্রোরেল কেন বিজ্ঞাপন ডিপো?’ কেন তৈরি হলো এমন বিরক্তিকর পরিবেশ- চলুন জেনে নিই- মেট্রোরেলের একটি কোচের ভেতরে গাদাগাদি করে অপরিকল্পিত উপায়ে লাগানো হয়েছে সারিসারি বিজ্ঞাপনী পোস্টার। দেখতে দৃষ্টিকটু এসব পোস্টার নষ্ট করছে মেট্রোরেলের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য। এতে করে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অধিকাংশ যাত্রী। অবশ্য করবেই বা না কেন! দেশের সম্পদ বলে কথা। আনন্দের বিষয় হলো, কিছুটা দেরি করে হলেও জাতি হিসেবে আমরা দেশের সম্পদের কদর বুঝতে পেরেছি। মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শুরুর পর দুই ধাপে উদ্বোধন কার্যক্রমের পর প্রথম ধাপে এই সেবার তেমন সুফল জনগণ না পেলেও দ্বিতীয় ধাপে সেটি নিয়ে আমরা দেখিয়েছি বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। কিন্তু আমাদের সেই সুখস্মৃতি হয়নি দীর্ঘস্থায়ী। মেট্রোরেলের একটি কোচের ভেতরে ছেয়ে গেছে বিজ্ঞাপনী পোস্টার। এখন প্রশ্ন হলো- বাঙালির চির স্বপ্নের মেট্রোরেলের সৌন্দর্য বিনষ্টের দায় কার? অবশ্য তার উত্তরও আছে আমাদের কাছে। মেট্রোরেলের মতো প্রায় অসাধ্য স্বপ্ন সাধনে যেসব পক্ষ নিয়োজিত ছিল বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারাও পারেন না এমন পরিকল্পিত সৌন্দর্য বিনষ্টের দায় এড়াতে। চীন, জাপানসহ বিশ্বের মেট্রোরেল ব্যবহারকারী দেশগুলো যেখানে দেখাচ্ছে সোজা পথ, সেখানে আমরা হাঁটছি বাঁকা পথে।
সেসব দেশে মেট্রোস্টেশনগুলো মূলত বিজ্ঞাপনের জন্য করা হয় ব্যবহার। সারি সারি নিয়ন সাইন ও হাই-রেজুলেশন ইলেকট্রিক সাইনবোর্ডের ব্যবহার করছে তারা। এতে করে যাতায়াতের সময় সহজেই সেগুলো চোখে পড়ছে যাত্রীদের। এমন পরিস্থিতিতে আরেকটি প্রশ্নের উত্তর না খুঁজলেই নয়- চীনের মতো একটি দেশ যদি মেট্রোরেল স্টেশনে বিজ্ঞাপনের সুন্দর বন্দোবস্ত করে মেট্রোরেলের ভেতরের অংশ নিট অ্যান্ড ক্লিন রাখতে পারে। সেখানে আমরা কেন পারছি না? আমরা এমনটি না পারার জন্য দায়ী আমাদের সিস্টেম তথা ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া। অবশ্য ব্যবস্থাপনা যেহেতু দুর্বল, সেহেতু বলার অপেক্ষা রাখে না- মেট্রোরেলে বিরাজ করছে কিছুটা অব্যবস্থাপনা। আর এই অব্যবস্থাপনার দরুন জন্ম হয়েছে এমন পরিস্থিতির। এমতাবস্থায় লোকজন যে এটিকে বিজ্ঞাপন রেল অ্যাখা না দিয়ে বিজ্ঞাপন ডিপো বলেছে সেটিও আমাদের জন্য চরম সৌভাগ্যের। হাজার কোটি টাকা খরচ করে যাত্রী সেবা দিতে গিয়ে যদি হাজার টাকার বিজ্ঞাপনের কাছে ধরাশায়ী হয়ে পড়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষ তবে বলতেই হয়- পাঁচ টাকার দড়ি না কিনে লাখ টাকার গরু কেনা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
মেট্রোরেলের একটি কোচে কর্তৃপক্ষের ব্যাপক উদাসীনতায় সৌন্দর্য হরণকারী বিজ্ঞাপন পেয়েছে ঠাঁই। ভাবনার বিষয় হলো, শুধু রেফ্রিজারেটর কোম্পানিটি চাইলেই কী স্বপ্নের এই মেট্রোরেলকে দুঃস্বপ্নে পরিণত না করে পারত না- মেট্রো স্টেশনগুলোয় নিয়ন সাইনসহ অন্যসব বিজ্ঞাপন প্রচার করতে- তবে তারা সেটি না করে বহুল প্রচারের আশায় হাত দিয়েছে দেশের মানুষের স্বপ্নের মেট্রোরেলের বুকে। পাঁচ টাকার দড়ির লোভে জনগণের হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পে কালি লাগাতেও দ্বিধাবোধ করেনি সংশ্লিষ্ট পক্ষ। এতে করে সংশ্লিষ্ট সবপক্ষের ওপর সাধারণ জনগণের তৈরি হয়েছে নেতিবাচক মনোভাব। এত এত আওয়াজ তোলার পর আদৌও কি উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে মেট্রোরেলের ভেতরকার বিজ্ঞাপন বিষবাষ্প- সেটিও আমাদের অজানা।
মনে রাখতে হবে, মেট্রোরেল আমাদের স্বস্তির বাহন। এটির সৌন্দর্য বিনষ্ট করা মানে বাঙালির হৃদয়াবেগ নিয়ে খেলা করা। বিজ্ঞাপন-সংশ্লিষ্ট এ বিষয় নিয়ে কর্তৃপক্ষকে আরো সচেতন হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন দাতা সংস্থার উচিত হবে বহির্বিশ্বের বিজ্ঞাপন কৌশল অনুসরণ করে সুন্দর ও দৃষ্টিকটু নয় এমন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মেট্রোরেল স্টেশনগুলোকে সাজিয়ে তোলা। তবেই মিলবে সুফল। একদিকে বাঁচবে সময়, আরেকদিকে প্রশস্ত হবে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় বাজার। সর্বোপরি সম্মৃদ্ধ হবে দেশ।
লেখক : কলাম লেখক
"