তানজিব রহমান

  ২০ নভেম্বর, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

পর্যটন অর্থনীতির করিডর দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন

পর্যটনশিল্প বর্তমান বিশ্বে বিলিয়ন ডলারের শিল্পমাধ্যম। এ শতাব্দীর সেরা শিল্পও বলা চলে, যা বর্তমান বিশ্বে একক বৃহত্তম শিল্পমাধ্যম। উন্নত বিশ্বে কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও পর্যটনশিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ১০০ বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করতে স্বাধীনতার ৩৮ বছর সময় লেগেছিল। কিন্তু গত ১২ বছরে জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে অর্থনীতির আকার চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বর্তমানে ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পর্যটনশিল্প হাতছানি দিয়ে ডাকছে সমগ্র বিশ্বকে, যা সরকারও গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে কল্পনাই করা যায় না। অনিন্দ্য সুন্দর কক্সবাজারের মূল আকর্ষণ হচ্ছে তার নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত হিসেবে কক্সবাজারের খ্যাতি জগৎজোড়া। প্রতি বছর পর্যটকের সংখ্যাও বাড়ছে হুহু করে। বাংলাদেশের পর্যটন রাজধানীখ্যাত কক্সবাজার পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ২০১৭ সালে মেরিন ড্রাইভ উদ্বোধনের পর। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই মেরিন ড্রাইভের এক পাশে উত্তাল সমুদ্র, আরেক পাশে সবুজে ঘেরা পাহাড়। এমন মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য বাংলাদেশ তো বটে বিশ্বেও বিরল। সমুদ্র সৈকতকেন্দ্রিক পর্যটন আকর্ষণে প্রতিবছর প্রায় ১৬ লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটক সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে আসেন। যার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। সে বিবেচনায় কক্সবাজারকে আরো পর্যটকবান্ধব ও আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলার চিন্তা এক এক করে বাস্তবায়ন করছে সরকার। পর্যটকদের যাতায়াত ব্যবস্থা আরো সহজ ও নিরাপদ করার জন্য চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত আজ বাস্তব রূপ লাভ করেছে।

২০১১ সালের ৩ এপ্রিল কক্সবাজারের ঝিলংজা এলাকায় এই রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে ট্রায়াল রান বা পরীক্ষামূলক চলাচল সম্পন্ন হওয়ার পর ১১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে ৩ কিলোমিটার আগে তৈরি করা হয়েছে দেশের প্রথম আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন। অনেকটা ঝিনুকের আদলেই গড়ে তোলা হয়েছে রেলওয়ে স্টেশনের অবকাঠামো। কক্সবাজার আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনে রয়েছে তারকা মানের হোটেল, শপিং মল, কনভেনশন সেন্টার, রেস্তোরাঁ, শিশু যত্নকেন্দ্র এবং লাগেজ রাখার লকারসহ অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, কক্সবাজার-গুনদুম রেলপথের কারণে বাংলাদেশ ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কের পথে একধাপ এগিয়ে যাবে। তা ছাড়া কক্সবাজার-গুনদুম পর্যন্ত মহাসড়ক সম্প্রসারিত হলে এর আরো বিস্তৃতি ঘটবে, যা মিয়ানমার হয়ে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং সিটির সঙ্গে আন্তদেশীয় মহাসড়কে সংযুক্ত করবে বাংলাদেশকে। ফলে পশ্চিমে আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে পূর্বে চীন অবধি ঐতিহাসিক ‘সিল্ক রুট’ হবে পুনরুজ্জীবিত। জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মধ্যকার পূর্বমুখী (লুক ইস্ট) অর্থনৈতিক দুয়ার হবে উন্মুক্ত। বিনিয়োগ-শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক বন্ধন সহজ হয়ে উঠবে। কৃষি খামার ও শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজারজাত এবং রপ্তানি সুবিধার প্রসার ঘটবে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের জনগণের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য ও সচ্ছলতা বৃদ্ধি পাবে।

পর্যটন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারিত হওয়ায় পর্যটকের সংখ্যা ৫০ লাখের অধিক হবে। এতে পর্যটকদের যেমন কক্সবাজার ভ্রমণ সহজ হবে, তেমনি কক্সবাজারে উৎপাদিত পণ্য কমমূল্যে পরিবহনের সুযোগ তৈরি হবে। পর্যটন আকর্ষণ সহজ হবে, আগমনও বৃদ্ধি পাবে আগের চেয়ে কয়েক গুণ। ফলে পর্যটন খাতের উন্নতির পাশাপাশি রেল খাতেও সরকারের আয় বৃদ্ধি পাবে। কক্সবাজার উপকূলে স্থাপিত অর্ধশতাধিক হ্যাচারিতে এক হাজার কোটি চিংড়িপোনা উৎপন্ন হয়। উৎপাদিত পোনা দিয়ে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের তিন লাখ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এ পোনা মাছ ট্রাকে সরবরাহ করতে গিয়ে অক্সিজেনের অভাবে প্রচুর পোনা মারা যায়, যা থেকে বাঁচতে ব্যবসায়ীদের কার্গো বিমানে পোনা সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে পরিবহন ব্যয় কমবে, সহজে বাণিজ্যিক কর্যক্রম পরিচালনা করা যাবে।

এ ছাড়া রেলপথ ঢাকাকে সরাসরি কক্সবাজারের সঙ্গে যুক্ত করলে বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রাম ও পর্যটন নগরী কক্সবাজারের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পর্যটনশিল্পের বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে রেলপথ প্রকল্পটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে মিয়ানমার, চীনসহ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের করিডরে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। ২৭টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের রেল নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। ইতিমধ্যে কক্সবাজারের উন্নয়ন, পর্যটক আকর্ষণে ও আধুনিকায়নে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও স্থাপিত হয়েছে। গত বছর ১৮ মে প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) উদ্বোধন করেন, যা একটি পরিকল্পিত পর্যটন হাব হিসেবে কক্সবাজারকে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।

কক্সবাজারের অর্থনৈতিক সক্ষমতার নতুন দুয়ার হিসেবে সেখানে হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর। কক্সবাজারের মহেশখালীতে নির্মিত হচ্ছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, যা আগামীর অর্থনীতিকে গতিশীল করতে ও কক্সবাজারে শিল্পায়নে অনন্য ভূমিকা রাখবে। বর্তমান সরকারের এমন সব ভিশনারি উদ্যোগ শুধু কক্সবাজার নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গেম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করবে। এতসব উন্নয়নের মহাসড়ককে ঢাকা তথা সমগ্র বাংলাদেশের সঙ্গে কক্সবাজারকে যুক্ত করতে রেল যোগাযোগ নিরাপদ সহজ ও জনবান্ধব পরিবহন হিসেবে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করবে। এতে করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মিরাক্যাল ম্যাজিকে পরিণত করার প্রক্রিয়াটি আরো একধাপ এগিয়ে যাবে।

সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পর্যটকের আগমন বেশি হয়। রেলের মতো নিরাপদ বাহন চালু হলে মৌসুমের বাইরেও পর্যটক বাড়বে। পর্যটক যত বাড়বে, পর্যটককেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যও তত বৃদ্ধি পাবে। কক্সবাজারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কয়েকটি খাত হলো মৎস্য, শুঁটকি, লবণ ও কৃষিপণ্য। পর্যটক পরিবহন ছাড়াও কম খরচে মাছ, লবণ, কাগজের কাঁচামাল, বনজ ও কৃষিজ দ্রব্যাদি পরিবহন করা যাবে রেলে। পর্যটকদের যাতায়াত আরামদায়ক ও নিরাপদ হবে। ট্রেন এলে কক্সবাজারের উৎপাদিত লবণ, মাছ, সবজি কম সময়ে সাশ্রয়ী দামে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলায় পৌঁছাবে; আবার অন্যান্য জেলা থেকেও সহজে কক্সবাজারের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা পর্যটক আকর্ষণীয় পণ্যসামগ্রী আমদানি করতে পারবে। দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন অবকাঠামো উন্নয়ন ও পর্যটন অর্থনীতিতে সুবাতাস বয়ে আনার পাশাপাশি বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূচনা করবে।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close